Feature Label 3

0
কমরেড আসাদ্দর আলী স্মৃতি পরিষদ,কমরেড আসাদ্দর আলী পরিষদ,কমরেড আসাদ্দর আলী,আসাদ্দর আলী,কমরেড আসদ্দর আলী,আসদ্দর আলী,কমরেড আছদ্দর আলী,আছদ্দর আলী মোহাম্মদ আব্দুস সালিক,ভাষা আন্দোলনে সিলেট,৫২ এর ভাষা আন্দোলন,comrade asaddar ali,asaddar ali,comrade assador ali,assador ali,sylhet

এই শ্রদ্ধেয় ব্যক্তির সংস্পর্শে আসা আমার জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। আমার ধারণা তাঁর সংস্পর্শে না আসলে হয়তোবা বামপন্থি প্রগতিশীল রাজনীতির সাথে আমার সম্পৃক্ততা ঘটতোনা। আমার ১২ বছর বয়সে এই ব্যক্তিটির মুখ থেকেই আমি কার্লমার্কস, রাসেল, লেনিন, এঙ্গেলস এবং মাও সে তুং এর নাম শুনতে পাই। স্কুলের ছাত্রাবস্থায়ই তাঁর কাছ থেকে শুনতে পাই যুক্তিপূর্ণ বস্তুবাদের দর্শন। প্রলিটারিয়েট বা বিত্তহীন সমাজের বিপ্লবের ফলে কি করে সা¤্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ, সামন্তবাদ, ধনিক, বণিক, মুৎসুদ্দি, বুর্জোয়া পুজিপতির দল শেষ পর্যন্ত পরাজিত হয়ে একদিন তারা বিশ্বে শ্রেণীহীন-শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে। আর এই মহান লক্ষ্য অর্জনে তথাকথিত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের জন্য কঠোর শপথ নিতে হবে। তবেই আসবে হতদরিদ্র মানুষের সত্যিকারের মুক্তি। ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’ এ কথাটি তিনি বার বার বলতেন। তিনি সিলেট থেকে যখন তাজপুরে বাড়ীতে আসতেন তখন আমি খেলাধুলা ফেলে কি যেন এক অজানা আকর্ষণে আমার বন্ধু বান্ধবদেও জড়ো করে উনাকে ঘিরে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকতাম তাঁর রাজনৈতিক বক্তব্যেই আমাদের আকর্ষণ ছিল বেশী। এত সুন্দর করে তিনি আমাদের সাথে কথা বলতেন, কিভাবে ঘন্টার পর ঘন্টা চলে যেত টেরই পেতামনা। মানুষ হিসেবে সমাজে আমাদের দায়িত্ব, কর্তব্য, মানবিক মূল্যবোধ, দেশের প্রতি আমাদের দায় দায়িত্ব কি হওয়া উচিত- এই সবই আলোচনার মূল বিষয়বস্তু থাকতো।
এছাড়াও এলাকার বিভিন্ন বিষয়, বিশেষ করে তাজপুরকে ঘিরে তাঁর স্বপ্ন, এলাকার সন্তান হিসেবে তাজপুরের উন্নয়নের ব্যাপারে আমাদের কি করা উচিত, এসব বিষয় নিয়েআলাপ-আলোচনা হত। তিনি সাধারণত: গ্রামে আসলে তাঁর নিজের বাড়ীতে না থেকে বিশেষ করে তাঁর দুই প্রিয় ভক্ত যারা তখনকার দিনে আমাদের এলাকার জনপ্রিয় এবং ক্ষমতাশালী ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিচিত ছিলেন, তাদের বাড়ীতেই অবস্থান করতেন বেশী। এই দু’জনের একজন হলেন আমার মামা কমরেড আজহার আলী অন্যজন তৎকালীন তাজপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আমার দুলা ভাই মোজাফফর আলী। আমি ছোটবেলা থেকেই উনার আদর্শে উদ্বুদ্ধ হই। একজন আদর্শবান ব্যক্তি হিসেবে তাঁর প্রতি আমার শ্রদ্ধা ও ভালবাসা ছিল প্রচুর। তাজপুর আমার নানা কমরেড আসাদ্দর আলী ও মামা কমরেড আজহার আলীরই অবদান ছিল। অত্র এলাকার যারা মাতব্বর, নেতা ও প্রভাবশালী লোক ছিলেন তারা কমবেশী সবাই কমরেড আসাদ্দর আলীকে শ্রদ্ধা করতেন। আমরা একদল বন্ধু বান্ধব ছিলাম যারা অধীর আগ্রহে জনাব আসাদ্দর আলী সাহেব কবে সিলেট শহর থেকে বাড়ীতে আসবেন এবং আমাদের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক আলোচনার ভিত্তিতে জ্ঞান দান করবেন সেই অপেক্ষায় থাকতাম। আমরা মন্ত্রমুগ্ধেও মতই সব সময় উনার আলাপ আলোচনা উপভোগ করতাম। আমি ভেবে অবাক হই যে তখনকার অজ পাঁড়াগায়ে আসাদ্দর নানা আমাদের কৈশোর জীবনের প্রারম্ভে মাও সেতুঙ, কার্ল মার্কস, লেনিন এদের সম্বন্ধে কথা বলতেন, যে কারণে আজও আসাদ্দর আলী নানাকে আমরা রাজনৈতিক আদর্শ হিসেবে চিন্তা করতে গর্ববোধ করি। উনার সংস্পর্শে এসে আদর্শ মানুষ হওয়া, ন্যায়নীতির মধ্যে জীবন যাপন করা, ইত্যাদি বিষয়ে ভাবতে ভাল লাগত, জানিনা কতটুকু আদর্শেও মধ্যে থাকতে পেরেছি। আমি নিজে ব্যক্তিগতভাবে উনার কাছে চিরঋণী। দুনিয়াতে এমন কোন সমস্যা নেই যা আমার শ্রদ্ধেয় আসাদ্দর নানাকে বললে সমাধান পাওয়া যেতনা। উনার সংস্পর্শে গেলে আমি এমন কোন লোক দেখি নাই যারা উনাকে শ্রদ্ধা করে নাই। আসাদ্দর নানার বাড়ি আমাদের গ্রামে হলেও উনি সিলেট থেকে বাড়িতে আসলে হয় আমাদের বাড়িতে না হয় আমার মামা কমরেড আজহার আলীর রাড়িতে অবস্থান করতেন। আর আমরা দল বেঁধে বন্ধু-বান্ধবেরা উনার কাছে বসে রাজনৈতিক আলোচনায় ডুবে যেতাম। কি সুন্দর ছিল আমাদের দিনগুলো।
আমি সকল সময়ই তাঁর চিন্তা-চেতনা এবং আদর্শকে আমার ব্যক্তি জীবনে প্রতিফলিত করার চেষ্টা করতাম। কৈশোর থেকে যৌবনে পদার্পণের প্রারম্ভে সিলেট মুরারিচাঁদ কলেজে অধ্যয়নকালীন সময় তাঁর খুবই কাছের মানুষ হিসেবে নিজেকে কিছুটা হলেও প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হই। আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু বান্ধবরা যখন অবসরে সিনেমা, নাটক, গান বাজনা বা আড্ডা নিয়ে ব্যস্ত থাকতো এবং আমাকেও তাদের সঙ্গী করার চেষ্টা করতো তখন আমি তাদেরকে অসন্তুষ্ট রেখেই কমরেড আসাদ্দর আলীর সিলেট শহরের ধোপাদিঘির পূর্বপারের ভাঙ্গা বৈঠকখানায় বসে উনার উপদেশমূলক বক্তব্য শুনতেই আগ্রহ দেখাতাম বেশী।
সিলেটের এমন কোন রাজনীতিবিদ নেই, সকল দলের ছাত্র নেতা থেকে আরম্ভ করে সে সময়কার ছোট বড় জেলা ও থানা পর্যায়ের নেতাদের আমি ঘন্টার পর ঘন্টা কমরেড আসাদ্দর আলীর ভাঙ্গা বৈঠকখানায় রাজনৈতিক আড্ডায় বসে থাকতে দেখেছি। সেখানে মূল আলোচনাই ছিল রাজনৈতিক। তিনি থাকতেন সব সময় মূল বক্তা। সিলেটের রাজনৈতিক সামাজিক যে কোন সমস্যাতেই তাঁর ধোপাদিঘির পূর্ব পারের বৈঠকখানা সরগরম হয়ে উঠতো। তাঁর রাজনৈতিক উপদেশ, মন্তব্য সে সভাগুলোতে প্রাধান্য পেত। আমি সহ সেখানে যে কয়েকজন কর্মী ভক্ত নিয়মিত উপস্থিত থাকতেন তাদের মধ্যে মগনী ভাই, আবুহেনা ভাই, আনোয়ার ভাই, হীরা ভাই, আফরোড, ধীরেনদা, ব্রজগোপাল, সালেহ আহমেদ, আলীনূর, এডভোকেট খলিলুর রহমান চৌধুরী, এডভোকেট মলয়দা, মনির উদ্দিন পিপি সাহেব, সাবেক এমপি লুৎফুর রহমান ( গোলাপগঞ্জ) কমরেড বুলিদা, কমরেড অজয় ভট্টাচার্য, অচিন্ত্যদা, নান্টুদা, নারায়ণদা, কাজলদা, মতছির আলি, শাহ আজিজ, নূরুল ইসলাম নাহিদ, গৌছুল আলম, মুকুলদা, ইয়ামীন চৌধুরী, মস্তাক, শিশু প্রমুখের নাম করা যায়। আমরা ছিলাম ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ভাসানী) ও ছাত্র ইউনিয়ন মেনন গ্রুপের সক্রিয় সদস্য। সে সময়কার সক্রিয় রাজনীতিবিদদের মধ্যে সর্বজন শ্রদ্ধেয় দেওয়ান ফরিদ গাজী, পীর হবিবুর রহমান, ছাত্রনেতা গুলজার ভাই, আক্তার ভাই সহ অনেককেই আমি নিয়মিত উনার সাথে যে কোন সংকটে শলাপরামর্শ করতে প্রত্যক্ষ করেছি।
সিলেটে যে কোন আন্দোলনের শুরুতেই পুলিশ  ও গোয়েন্দা বিভাগের লোকজন প্রথমেই জনাব আসাদ্দর আলী সাহেবকে গ্রেফতারের জন্য মরিয়া হয়ে উঠতো। কারণ তারা জানতো সিলেটে কোন স্বার্থক সরকার বিরোধী আন্দোলনে বিশেষ করে আন্দোলনকে চাঙ্গা করতে কমরেড আসাদ্দর আলীর পরামর্শ মন্ত্রের মতো কাজ করতো। এক কথায় গোয়েন্দাদের প্রতি উপর মহলের নির্দেশ থাকতো সিলেটে সরকার বিরোধী আন্দোলন থামাতে হলে আসাদ্দর আলীকে বন্দি করতে হবে আগে। সিলেটে সরকার বিরোধী যে কোনো আন্দোলনের প্রথমেই প্রশাসন আসাদ্দর আলীকে এরেষ্ট করার জন্যে সক্রিয় উঠতো।
তিনি খুবই গুণী ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর বাচন ভঙ্গী, উপমা, উদাহরণ, কথার মালা সাজিয়ে তিনি যেভাবে বক্তব্য উপস্থাপন করতেন তা শুনে আমার মতো অনেকেই অভিভূত হয়ে তার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে যেতেন। এ জাতীয় বহু ঘটনা রয়েছে। এসবের স্মৃতিচারণ করলে আমার মন খারাপ হয়ে যায়। এই মুহূর্তে সবকিছু আমার পক্ষে ভাষায় বর্ণনা করা সম্ভব নয়। এটা ছিল অনুভূতির ব্যাপার। তিনি খুব সুন্দর কবিতা ও গান লিখতেন। এ কারণে আমরা অনেকে তাঁকে কবি সাহেব বলে ডাকতাম। তিনি হোমিওপ্যাথিক বই পড়ে গরীব অসহায় রোগীদের চিকিৎসা করতেন। এবং নিজের পয়সায় তাদের ঔষধ কিনে দিতেন। এ কারণে কেউ তাকে ডাক্তার সাহেব বলেও সম্বোধন করতেন। সার্বক্ষণিক চিন্তা-ভাবনা এবং কাজ আমাকে সব সময় অভিভূত করে ফেলতো। আমার মনে হয় তার জীবনটাই ছিল মানুষের জন্যে। ত্যাগ তিতিক্ষায় ভরা ছিল তার সমস্ত জীবন।
মানুষের সেবা করার জন্য জীবনে বিয়ে না করার সিদ্ধান্তই নিয়ে ছিলেন।
ষাটের কোঠা অতিক্রম করার পর আমাদের সবার অনুরোধে তাঁর বয়সের সাথে মিল রেখে মূলতঃ শেষ বয়সে একজনকে জীবন সঙ্গিনী করার সিদ্ধান্ত নেন। আমি তাঁকে নানা, কবি সাহেব, উস্তাদ, আসাদ্দর ভাই বলেও সম্বোধন করতাম। তার বিয়ের সংবাদে আমরা তার ভক্ত হিসেবে খুবই আনন্দিত হই। নানীর সাথে পরিচিত হওয়ার পর তার পছন্দ ও সঠিক সিদ্ধান্তকে আমরা সাধুবাদ জানাই।
আমার অনেক স্মৃতি বিজরিত নানা কমরেড আসাদ্দর আলীর কথা মনে হলে আমি স্বাভাবিক ভাবেই আবেগ প্রবণ হয়ে উঠি। এই লোকটির অবদান আমার জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপেই জড়িয়ে আছে। জীবনের যে কোন সমস্যায় পড়লেই আমি তার শরণাপন্ন হতাম। তিনি খুবই সুন্দর ভাবে আমার জীবনের যত জটিল সমস্যা হোক না কেন অত্যন্ত আন্তরিকাতার সাথে সমাধান করে দিতেন। উদাহরণ স্বরূপ আমার বিয়ের ব্যাপারটা এখানে উল্লেখ করতে চাই। আমার অধ্যয়ন সমাপ্তির পূর্বেই ১৮ বছর বয়সে বাবা আমাকে বিয়ে দিতে চান। সেই বয়সে আমার বিয়ে করার ইচ্ছে ছিলনা। আমাদের পিতাপুত্রের সম্পর্ক এ নিয়ে ঝুঁকির মধ্যে পড়ে গিয়েছিল। আমার বাবা ও আমি দুজনেই তখন আসাদ্দর আলী সাহেবের দ্বারস্থ হই। তাঁর মোহন স্পর্শে আমি আব্দুস সালিক শেষ পর্যন্ত কিভাবে যে বিয়েতে রাজি হয়ে গেলাম বুঝতেই পারিনি।
পারিবারিক সমস্যা বা বিভিন্ন জটিলতায় তাঁর পরিচিত অনেককেই তাঁর কাছ থেকে পরামর্শ নিতে দেখেছি। উনি একজন অত্যন্ত অভিজ্ঞ মধ্যস্থতাকারী ছিলেন। আমাদের এলাকায় প্রবাদ ছিল যে, ‘আসাদ্দর আলীর ট্যাবলেট কেউ খেলে তার ক্রিয়া থেকে মুক্তি পাওয়া কঠিন’। আত্মীয় স্বজন বা এলাকার অনেকেই বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে তার শরনাপন্ন হতেন। তিনি এতো সুন্দর ভাবে সবাইকে সন্তুষ্ট করতেন, আমার মনে হয় এ কারণে এলাকাবাসীর কাছে এই প্রবাদটি জনপ্রিয়তা লাভ করে। তাঁকে সব বয়সের মানুষকে অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে গ্রহণ করতে দেখেছি। মানুষ কত আন্তরিকভাবে একজন প্রগতিশীল সৎ, ত্যাগী, সর্বহারা মানুষের  নেতা হিসেবে সম্মান করে। কত স্বার্থকভাবে তাঁর মতামতের পক্ষে মানুষকে একত্রিত করতেন তা দেখে এ মানুষটির প্রতি শ্রদ্ধায় আমার মাথা নত হয়ে যেত। আমার কাছে আসাদ্দর ভাই ছিলেন সর্ব রোগের মহৌষধ। তিনি জীবিত থাকতে আমার সার্বক্ষণিক যোগাযোগ ছিল। আমি উনাকে একজন পরশমনি হিসেবে ভাবতাম। উনার সংস্পর্শে কত খারাপ মানুষ ভাল হয়ে গেছে। তিনি অত্যন্ত প্রচার বিমুখ ছিলেন। অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে সকল সময় তাঁকে সোচ্চার ও সক্রিয় ভূমিকা নিতে দেখেছি।
আমি ১৯৭০ইং ফেব্রুয়ারি মাসের ৩ তারিখে লন্ডনে পোঁছি। এর কিছুদিন পরেই বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ আরম্ভ হয়ে যায়। আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ে আমি দেশে, বিশেষ করে, ছাত্রদের  ১১ দফার আন্দোলনে অত্যন্ত সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলাম । বিলেতে পোঁছেই আমি ভাসানী ন্যাপের এবং ছাত্র ইউনিয়নের মেনন গ্রুপের চিন্তাভাবনার মানুষদের খুঁজে বের করার চেষ্টা করি। প্রোচাইনিজ কমিউনিস্টদের খোঁজ-খবর নিয়ে আমরা সম্মিলিতভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ি। এ ব্যাপারে কমরেড আসাদ্দর আলী আমাকে ইতিপূর্বে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দান করেছিলেন।
আমি এবং আমার পরিবারের কেউ কোনদিনই আওয়ামীলীগের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলাম না। প্রগতিশীল রাজনীতির সাথে নিজেকে জড়াতে পেরে নিজের চিন্তা ভাবনার প্রতি রীতিমত গর্ববোধ করতাম। প্রবাসে আমার সাথে বেশ কিছু গুণীজনদের পরিচয় ঘটে। তাদের মধ্যে জনাব আব্দুস সবুর, ব্যারষ্টার আশিক আলী, জিয়া উদ্দিন মাহমুদ, ডাঃ তালুকদার, ব্যারিষ্টার লুৎফুর রহমান শাহজাহান কামাল লোহানী, মুসা ভাই, জগলু ভাই সহ অনেকের সাথে ঘনিষ্ট হয়ে পড়ি। “জনযুদ্ধ” নামে আমরা একটি পত্রিকা বিলেতে বের করি। আমি উনাদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ ছিলাম। তবে উদ্দীপনা উৎসাহের কোন কমতি ছিল না। তখন বিলেত প্রবাসীদের মধ্যে বেশীর ভাগ লোকই আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবের সমর্থক ছিলেন। তাদের তুলনায় আমাদেও সংখ্যা অনেক কম । তবুও আমরা আমাদের অবস্থান থেকে জনসংযোগ ও প্রবাসীদের মধ্যে আমাদের প্রচার বার্তা চালিয়ে মোটামুটি একটা অবস্থানে এসে পোঁছি। আমার বাড়ি সিলেটে থাকার কারণে আমার অবস্থান ছিল একটু সুদৃঢ়। আমাদের দলের মধ্যেও আমার উপস্থিতি সবাইকে একটু স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতে সাহস যোগাত। আমি আমার বন্ধু বান্ধব নিয়ে বিশেষ করে পূর্ব লন্ডনে “জগযুদ্ধ” বিতরণ করতাম। আমাদের প্রচার ছিল পাকিস্তান ও ইন্ডিয়ার বিরুদ্ধে। ইন্ডিয়ানদের সাহায্য নিয়ে আমরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা চাইনি। কারণ আমাদের দেশের ভেতর থেকে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ করে বাংলদেশে সমাজতন্ত্র কায়েম করে জনগণতান্ত্রিক বাংলাদেশের জন্ম হউক বলে আমরা স্বপ্ন দেখতাম।
আমাদেও দলে সাথে অত্যন্ত বিদ্বান ও তাত্ত্বিক লোকদেও সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল। উনারা কোন সভা সমিতি করতে গেলে এবং প্রচার কার্য করার চেষ্টা করলে তখনকার দিনে আওয়ামীলীগাররা উনাদের অসহযোগিতা করত। আমাদেও দলের সিলেটি বন্ধু-বান্ধব ছাড়া তখনকার পরিবেশে স্বাধীনতার পক্ষে আওয়ামীলীগ ব্যতিত অন্য কারো পক্ষে রাজনৈতিক কর্মকান্ড চালানো বড় কঠিন ছিল।
আমরা আমাদের মধ্যে চাঁদা সংগ্রহ করতাম। কমরেড আসাদ্দর আলী, জাফর ভাই, মেনন ভাই, কমরেড তোয়াহা প্রমুখ নেতাদের সাথে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করে ভারতে আর্থিক সাহায্য প্রদান করতাম। তখনকার দিনে প্রবাসী বাঙালীদেও মধ্যে স্বাধীনতার পক্ষে কি উদ্দীপনা ও সংগ্রামের মনোভাব ফুটে উঠেছিল বাস্তব ক্ষেত্রে চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। মানুষ দিন রাত মিটিং মিছিল করে নিজেদের উপার্জনের প্রতিটি পেনি বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সাহায্যার্থে প্রেরণ করেছেন। প্রবাসীদেও অন্যান্য দাবী দাওয়ার সংগ্রামে নিজেকে সম্পৃক্ত করার প্রয়াসে আমাকে পূর্ব লন্ডনে স্থায়ীভাবে বসবাস করার সিদ্ধান্ত নিতে হয়।
ব্রিকলেনে বাঙালিদেও এখানকার মত এখনকার মত তখন এত প্রতিপত্তি ছিল না। বরং পাকিস্তানীদেও ব্যবসা বাণিজ্য প্রভাব প্রতিপত্তি আমাদের তুলনায় সেখানে বেশী ছিল। প্রতি সপ্তাহে ৩/৪ বার বাঙালী পাঞ্জাবীর মধ্যে সরাসরি মারামারি লেগেই থাকত। নিজে যতটুকু সম্ভব এসব কর্মকান্ডে বাঙালীদের সাথে জড়িত থাকতাম। তখন আমরা বাঙালীরা সাধারণত পাঞ্জাবীদের ক্যাফে-বারগুলোতে খাওয়া দাওয়া করতাম। কারণ তখন বাঙালীদের কোন রেস্তোরা ব্রিকলেনে ছিলনা। আমরা কিছু বন্ধু-বান্ধব মিলে একটি কফি বার স্থাপন করার উদ্যোগ নেই। কফি বারের নাম দেওয়ার দায়িত্ব আমার উপর পড়ে। আমি সিলেটে ছাত্রাবস্থায় থাকার সময় আমার বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে বন্দর বাজার নিরালা রেষ্টুরেন্টে আড্ডা মারতাম। এই নিরালা রেষ্টুরেন্টের নামানুসারে তখন আমি নিরালা ভোজনালয় নামকরণ করি। আমার লন্ডনে স্থায়ীভাবে বসবাস করার পুরোপুরি বৈধতা না থাকার কারণে আমি তখন আমার দুই বন্ধুকে যৌথভাবে ব্যবসা করার অনুপ্রেরণা যোগাই। এই কফি বার করার পেছনে আমার সক্রিয় ভূমিকা ছিল। ব্যবসাটি খোলার সাথে সাথেই জমে উঠেছিল। তখন আমরা সবাই মিলে বিশেষ করে যুবকেরা ওখানেই আড্ডা জমাতাম। দেশের স্বাধীনতার পক্ষে জনগণকে সংগঠিত করা, সভা সমিতি মিছিলে যোগদান করা, বাঙালদিলের পক্ষে প্রচার কার্য চালিয়ে যাওয়ার কেন্দ্র স্থলে পরিণত হয় এই রেস্তোরাটি।
আমার আজো মনে পড়ে সে সব মুরব্বীদের কথা যাদের মধ্যে আজ অনেকেই বেঁচে নেই। কিন্তু আমার সে গড়ে উঠা সম্পর্কেও কারণে আমি প্রবাস জীবনে উনাদেও কাছ থেকে অনেক সাহায্য সহযোগিতা পেয়েছিলাম। তখন মানুষের চোখে মুখে আমি দেশপ্রেম এবং বাংলাদেশের জন্য এত মায়া-মমতা দেখেছিলাম যেটা আমার জন্য একটি ব্যতিক্রমধর্মী অভিজ্ঞতা। আমার স্মৃতির পাতায় আজো সেই দিনগুলি চির অমলিন। তখন আমাদের আন্দোলন সম্বন্ধে দেশে চিঠি লেখা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। কারণ বিদেশ থেকে আগত চিঠিপত্র সামরিক শাসকরা সেনসর করে দেখত এবং প্রাপকদের নানা প্রকারের হয়রানী, এমনি অত্যাচারও করত। তাই দেশে যাতায়াতকারী বিশ্বস্ত লোকজনের মাধ্যমে আসাদ্দর আলী সাহেবের কাছে চিঠি পাঠিয়ে আমাদের আন্দোলন সম্পর্কে ওয়াকিবহাল রাখতাম এবং টাকা পয়সাও পাঠাতাম।
আমি নির্ভরযোগ্য সূত্রে সংবাদ পেলাম যে আমার শ্রদ্ধেয় আব্বাকে পাঞ্জাবী সৈন্যরা নির্মমভাবে আমাদের বাড়ীতে এসে শারীরিক নির্যাতন করেছে। খবর শুনে আমি তো পাগল প্রায়। আমার বাবা কোন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন না। সমস্ত জীবনই বিলেতে ছিলেন। মাত্র কয়েক বছর থেকে দেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করছিলেন। শারীরিকভাবে উনাকে নির্যাতন করার কারণ আমি খুঁজে পাইনি। পরে শুনলাম যে, নতুন বাড়িটি ইলাশপুর গ্রামে (সিলেট-মৌলভীবাজার মহাসড়কের সাথে সংলগ্ন) উনি অতি সুন্দর ও যতœ সহকারে সাজিয়েছিলেন। সে বাড়ির মায়ায় উনি সব আত্মীয়-স্বজনের অনুরোধ শর্তেও বাড়িটি ছেড়ে পালাতে চান নি। উনার ধারণা ছিল উনি যেহেতু রাজনীতিবিদ নন, উর্দু-হিন্দিতে এবং ইংরেজীতে অনর্গল কথা বলতে পারতেন, পাঞ্জাবী, পাকিস্তানীদেও সাথে বিলেতে উঠাবসা, কাজকর্ম করেছেন। উনার বিশ্বাস ছিল তারা উনার সাথে বরং বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহার করবে। যেহেতু আমাদের গ্রামটি হিন্দু গ্রাম এই গ্রামটি রাজাকার আলবদরদের প্ররোচনায় পাঞ্জাবীদের টার্গেটে পরিণত হয়। হঠাৎ করে তারা মানুষদের আক্রমন
করে ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়, মানুষদেরকে গুলি করে আমাদের বাড়িতে উপস্থিত হয়। আমাদের বাড়িও জ্বালিয়ে দিত, উনার সাথে আলাপ আলোচনার সময় তারা বুঝতে পারে এ বাড়িটি হিন্দুদের নয়। পরে শুনেছি বাবা নাকি তাদেরকে বুঝানোর চেষ্টা করেছিলেন যে গ্রামের সব হিন্দুরা ইন্ডিয়া চলে গেছে। যারা আছে তারা মুসলমান। এ কথায় ক্ষিপ্ত হয়ে উনাকে মারধর করে। তাদের মাঝে যে রাজাকার ছিল তারা এর আগে গ্রামের হিন্দুদেরকে পাঞ্জাবীদেও কাছে ধরিয়ে দিয়েছিল। বাবার উপর অত্যাচার করে ওরা চলে যায়। আমার বাবা অত্যন্ত সাহসী লোক ছিলেন। পাঞ্জাবী সৈন্যরা যাওয়ার পর আমাদের আমাদের আত্মীয়-স্বজন যারা লুকিয়ে বাড়ির আনাচে কানাচে ছিল তারা দৌড়ে এসে উনাকে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যেতে চান। কিন্তু তিনি কোন অবস্থাতেই বাড়ী ছেড়ে অন্যত্র যেতে চান নি।
রাত্রে তাদের গোপন আস্তানা থেকে আসাদ্দর আলী নানা ও আমার মামা আজহার আলী সাহেব আমাদের বাড়ীতে আসেন এবং বাবাকে বুঝিয়ে অন্যত্র নিয়ে যান। সংগ্রামের নয় মাস উনি বিভিন্ন স্থানে আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতে পরিবারের অন্যান্যদেরকে নিয়ে বসবাস করেন। উনি ডায়াবেটিক রোগী ছিলেন। রীতিমত ঔষধ পথ্যাদি উনি সেবন করতে পারেন নি, নিয়মিত ডাক্তার দেখাতে পারেননি সেই কারণে উনি অনেক দুর্বল হয়ে পড়েন। স্বাধীনতার পর আমার সাথে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হওয়াতে আমাকে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে বলেন।
তখন গ্রামের এবং এলাকার পরিস্থিতি বদলে যায়। সংগ্রামের আগে উনার যে প্রতিপত্তি প্রভাব গ্রামে ছিল, উনার শারীরিক অসুস্থতার কারণে, এবং আমার অনুপস্থিতির জন্য সবকিছু উলটপালট হয়ে যায়। উনি এটাকে স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেননি। আমি তখন এই পরিস্থিতি সম্বন্ধে পুরোপুরি বুঝতে পারি নাই। আমার বিলেত থাকার বৈধ কাগজপত্র তখনও ঠিক হয়নি। নতুন দেশ আমাদেও হাইকমিশন তখনও স্বাভাবিক কাজ আরম্ভ করেনি। আমি ঝুঁকি নিয়ে কোন কিছু না করেই দেশে আসবার প্রস্তুতি গ্রহণ করি। আমার মামা আলী সাহেব ও কমরেড আসাদ্দর আী সাহেব আমাকে বাড়িতে আসতে চিঠি লিখেন। বাবার শরীরটা এত খারাপ তা অনুমান করতে পারিনি। কারণ আমি বিদেশ যাওয়ার পর তিনি প্রতিটি চিঠিতে আমাকে দেশে ফিরে আসতে বলতেন। আমার কাগজপত্র ঠিক করতে কিছু সময় লাগে। এরপর আমি ১৯৭২ সালের প্রথম দিকে দেশের পথে রওয়ানা দেই। ফাকা এয়ারপোর্টে যখন আমি আমার বন্ধুদেরকে দেখতে পাই তখন আমার সন্দেহ হয় বাবা মনে হয় বেঁচে নেই। দুঃসংবাদের ভয়ে আমি কাউকে কিছু জিজ্ঞাসা করি নাই। তারাও আমাকে কিছু বলেনি। সিলেটে পৌঁছার পর প্রচুর আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবকে এয়ারপোর্টে দেখে আমার সন্দেহ আরো গাঢ় হয়। সবার নিরবতা আমার মনে সন্দেহ আরো বাড়িয়ে দেয়। তাজপুর সংলগ্ন আমাদের পারিবারিক গোরস্তান যখন অতিক্রম করি তখন আমি একটি নতুন কবর সেখানে দেখতে পাই। আমি ভয়ে কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করি নাই। বাড়িতে এসে দেখি মানুষ আর মানুষ। আমাকে দেখে সবাই চিৎকার করে কান্না কাটি শুরু করে। আসাদ্দর আলী নানা ও আজহার আলী মামা আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরেন। তাদের কান্নায় আমি হতবাক হয়ে যাই। আজেফর আলী মামাই হৃদয় ফাটা কান্নায় বলে উঠেন “তোর বাবা নাই।” এ কথা বলে ই তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়ার উপক্রম। তখন আর আমার বুঝতে বাকি থাকে নাই যে মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে আমি বাবাকে চিরদিনের জন্য হারিয়ে ফেলেছি। তিন দিন আগে দেশে আসতে পারলে আমার বাবাকে আমি শেষ দেখা দেখতে পারতাম। বাবার অবর্তমানে যে মানুষের জীবন কত অসহায় তা অনুধাবন করতে লাগলাম। যারা আগে কারণে অকারণে আমাকে গুরুত্ব দিত, আমার সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য আকুলি বিকুলি করতো তাদের কাছে আমার গুরত্ব কমে যাওয়ার সমস্ত লক্ষণ আমি বুঝতে লাগলাম। আমি বুঝতে পারলাম বেশীর ভাগ লোকই আমার বাবার কারণে আমাকে অনেক গুরুত্ব দিত।
জীবনে চলার পথে এটি একটি ব্যতিক্রমধর্মী অভিজ্ঞা। আমি মানসিকভাবে বিলেতে আর না যাবারই সিদ্ধান্ত নেই। বাবা যে সহায় সম্পত্তি রেখে গেছেন তা সুচারুরুপে পরিচালিত করতে আমার ভবিষ্যৎ নিয়ে তেমন চিন্তার কোন কারণ নেই। আমার ছোট ভাই বোনদের নিয়ে সংসার জীবনে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার প্রস্তুতি নেই। আমাদের এলাকায় যারা এতদিন আমার নেতৃত্বেই সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকান্ড চালাত তাদের মধ্যে অনেকেই এখন সমাজের দন্ডমুন্ডের অধিকারী। সুতরাং সামাজিক ভাবে আমার তেমন অসুবিধা হওয়ার কারণ নেই।
এছাড়া আমার ঘনিষ্ট বন্ধু-বান্ধব এখন সমাজের কর্তা ব্যক্তি। তবে একটা অসুবিধা আমাকে চিন্তিত করে তোলে যারা আমার সঙ্গে প্রগতিশীল রাজনীতির সাথে জড়িত হয়ে গেছে। তবুও আমার সাথে তখনও চমৎকার ব্যক্তিগত সম্পর্ক বর্তমান ছিল। তখন একটা সমস্যায় আমি পড়েছিলাম যে আমার বিলেত যাওয়ার আগের প্রভাব প্রতিপত্তি যেটা ছিল তার অনেকটা হ্রাস পেয়েছে। হ্রাস পাওয়ার কারণে রাজনৈতিক পরিবর্তন ও আমার বাবার পরলোকগমণ। তবে কমরেড আসাদ্দর আলী ও কমরেড আজহার আলী সুচিন্তিত পরামর্শে ও দিক নির্দেশনায় আমি একবারে ভেঙ্গে পড়িনি।
আমি নতুন করে আমার আদর্শ, রাজনৈতিক চিন্তা ভাবনার ক্ষেত্র তৈরীতে ঝাপিয়ে পড়ি। কিন্তু পরিস্থিতি আগের চেয়ে অনেক জটিল হয়ে পড়ে। আমার পুরানো কমরেডদের সাথে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে তখনকার ক্ষমতায় যারা প্রতিষ্ঠিত ছিল সেই আওয়ামীলীগ নেতাদের সাথে আমার মতপার্থক্য দেখা দেয়।
ইতিমধ্যে এলাকায় কিছু ঘটনা সংঘটিত হয়। গোয়ালাবাজারে প্রভাবশালী নেতাদের নেতৃত্বে রিলিফ চুরির প্রতিবাদে  আমি জনগণকে সংগঠিত করতে গিয়ে ঝগড়াঝাটি ও মারামারির সম্মুখীন হই। সে সময় এলাকার ডাকাতদের উপদ্রব বেড়ে যায়। আমি আমার  বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে রক্ষী বাহিনী ও পুলিশদের সাহায্যে ডাকাত ধরতে সক্রিয় হয়ে উঠি। তখন দয়ামীরে ডাকাতদের গুলিতে আমার পরিচিত একজন প্রবাসী নিহত হন। এর প্রতিবাদে আমি সক্রিয় ছিলাম। সেখানে দুইজন ডাকাত গণপিটুনিতে নিহত হয়। আমাকে ডাবল মার্ডার কেইসে জড়িত করে ষড়যন্ত্রকারীরা আমার বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দেয়।
ইতিমধ্যে সিরাজ সিকদারের দল সর্বহারা পার্টি সিলেট জেলার বালাগঞ্জ থানা লুট করে। আমার শ্রদ্ধেয় নেতা কমরেড আসাদ্দর আলীর কাছে তখনকার আওয়ামীলীগ লিডাররা আমার বিরুদ্ধে নালিশ করেন যে সালিক বেশী বাড়াবাড়ি আরম্ভ করেছে। আওয়ামীলীগারদের বিরুদ্ধে এবং আমাদের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে আপত্তিকর কথাবার্তা বলে। বালাগঞ্জ থানা লুট হওয়ার কমান্ডে আমরা সালিককে সন্দেহ করি। তখন একদিন আসাদ্দর ভাইয়ের নেতৃত্বে সিলেট থেকে আমরা বামপন্থি কিছু নেতা আমার বাড়িতে আসেন এবং আমাকে আবার বিলেত যাওয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করেন। এরা সবাই আমার হিতৈষী। তাদের ধারণা ছিল আমি তখন যদি এলাকা থেকে না সরে যাই তাহলে আমার সমূহ বিপদের সম্ভাবনা আছে। আমার বিরুদ্ধে প্রতিবেশী ও মুক্তিযেুদ্ধের প্রধান সেনাপতি এবং তদানীন্ত মন্ত্রী এমএজি ওসমানীর কাছে নানা অভিযোগ যাচ্ছে আমাকে যেন গ্রেফতার করে জেলে ঢুকিয়ে দেয়া হয়। আমার কর্মকান্ড আওয়ামীলীগারদের বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দিচ্ছিল। সে সময় দেশে আমার প্রায় ২ বছর অবস্থান হয়ে গেছে। মুরব্বীদের এবং আমার হিতৈষীদের ও পরিবারের চাপে, বিশেষ করে আমার নেতা কমরেড আসাদ্দর আলী ও কমরেড আজহার আলীর পরামর্শে আমাকে বিলেত পাড়ি দিতে হয়।
শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক বাকশাল গঠন করার পর আমার রাজনৈতিক সহকর্মীদের উপর বাংলাদেশে নানান অসুবিধার সম্মুখীন হয়ে প্রবাসে আমাদের সাথে যোগাযোগ করেন। প্রগতিশীল প্রবাসী সহকর্মীদর সাথে বাকশাল বিরোধী রাজনীতিতে আমি জড়িয়ে পড়ি।
ইতিমধ্যে আমার বাংলাদেশের রাজনৈতিক জীবনের একজন প্রভাবশালী নেতা কাজি জাফর আহমেদ হঠাৎ করে আমাকে লন্ডন থেকে টেলিফোনে আমার সাথে যোগাযোগ করেন এবং আমাকে বলেন যে বাকশাল সরকারের ভয়ে উনি ইন্ডিয়া হয়ে পালিয়ে বিলেত পাড়ি জমিয়েছেন। উনার আত্মীয়-স্বজন, রাজনৈতিক বন্ধু-বান্ধব কেউই উনাকে সাহায্য সহযোগিতা দিচ্ছে না। তাদের ভয় কাজী জাফরকে শেলটার দিলে তাদের সিটিজেনশীপ বাংলাদেশ সরকার বাতিল করে দেবে। তাদে কে বাংলাদেশে কোনদিন না কোনদিন যেতে হবে এবং হয়ত বিপদে পড়তে হবে। জাফর ভাইয়ের কাছে কোন টাকা পয়সা ছিল না। থাকার জায়গাও নেই। আমি সাথে সাথে তিনি এবং তাঁর সহকর্মী হারুণ রশিদকে গিয়ে আমার বাসায় নিয়ে আসি। আমি ঝুঁকি নিয়ে জাফর ভাইয়ের সব দায়-দায়িত্ব গ্রহণ করি। উনি আমার সাথে কয়েক মাস অবস্থান করার পর একদিন আমার কাজের টেবিলের পাশে বসে গল্প করছিলাম তখন হঠাৎ করে বিবিসি রেডিও তে বিশেষ বুলেটিন প্রচার করা হয়। বলা হয় বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এবং তাঁর পরিবারকে বাংলাদেশের আর্মিরা সপরিবারে হত্যা করেছে। আমি অবাক হয়ে দেখেলাম আমার নেতা কাজী জাফর আহমেদ অঝোর ধারায় চোখের পানি ফেলে বার বার বলছিলেন, ‘এটা কি হলো? এটা অন্যায়।’
যে লোকটি নিজের প্রাণের ভয়ে, শেখ মুজিব সরকারের ভয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন সেই লোকটির প্রতিক্রিয়া দেখে শ্রদ্ধায় আমার মাথা অবনত হয়ে আসে। আমি জাফর ভাইকে জড়িয়ে ধরি। উনার কান্নাকাটি দেখে আমারও চোখে পানি আসে। আমিও শেখ মুজিবের জন্য অনুতপ্ত হই। উনি বাংলাদেশের সর্বশ্রেষ্ঠদের মধ্যে একজন বীর বাঙালী হিসেবে নিজের জীবনের অনেক ত্যাগ তিতিক্ষায় জাতিকে একটি দেশ উপহার দিয়ে এই নির্মম পরিণতির শিকার হন। এটা জাতির জন্য একটা কলংকের ইতিহাস হয়ে থাকবে।
জাফর ভাইকে আমি জিজ্ঞাসা করলাম শেখ সাহেবের মৃত্যু তাঁকে দেশে যাওয়ার কি সুযোগ সৃষ্টি করে দিল। উনি বললেন-“শেখ সাহেবের এ পরিণতি আমি প্রত্যাশা করিনি।” আমি আওয়ামীলীগের অনেক বঙ্গবন্ধুভক্ত নেতাদেরকে দেখলাম রাতারাতি তারা বাকশাল বিরোধী বক্তব্যে সক্রিয় হয়ে উঠে এবং শেখ সাহেবের সমালোচনায় আত্মনিয়োগ করেন। বাকশাল গঠনের পর লন্ডনে আমি সবুর ভাই, আশিক ভাই, শহিদ ভাই, সাদিক সহ জাফর ভাইকে নিয়ে বিশেষ করে পূর্ব লন্ডনে আমাদের আওয়ামীলীগ বন্ধুদের সাথে বিভিন্ন সভা সমিতিতে ও ব্যক্তিগত বৈঠকে তর্কবিতর্কে জড়িয়ে অনেক ঝগড়া ঝাটি করতাম। আমরা শেখ সাহেবের সমালোচনা করতাম এবং আওয়ামী নেতারা উনার পক্ষে আমাদের সাথে রাজনৈতিক ঝগড়া ঝাটি করতেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় যে তাদের অনেকেই শেখ সাহেবের মৃত্যুর পর আমাদের চেয়েও মুজিব বিরোধী সমালোচনায় অতি সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে আমি দেখেছি। উনারা মোস্তাক আহমেদের সরকারকে সমর্থন করার জন্য প্রবাসী বাঙালিদের সংগঠিত করতে সক্রিয় ভূমিকা নেন, এমন কি কেউ কেউ মোস্তাকের সমর্থনে দেশে চলে যান। প্রবাসে থেকেও আমি তাজপুর নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখতাম। এলাকাতে আমার অবর্তমানে আমার মামা ও কমরেড আসাদ্দর আলী সাহেব সহ অন্যান্যরা যখন তাজপুর কলেজ স্থাপনের চিন্তাভাবনার কথা আমাকে জানালেন তখন আমি আমাদের এলাকার প্রবাসীদের সংগঠিত করে আমার মামাকে ব্যক্তিগত ভাবে কলেজের নামকরণ আমার মামা আজহার আলীর নামে করার অনুরোধ করি। তাজপুর কলেজটি তখন মঙ্গলচন্ডী হাইস্কুলে ক্লাশ নিতে আরম্ভ করে। নির্ধারিত এলাকায় তখনও কোন স্থায়ী ঘর করা হয় নি। কিছু দিন পর আমিও দেশে চলে আসি। তখন দেশে আওয়ামী সরকার চলছে। তখন আমার এলাকায় প্রভাবশালী এমপি বঙ্গবীর জেনারেল ওসমানী, বাংলাদেশের মন্ত্রী।
এলাকায় এসে দেখলাম আওয়ামীলীগ নেতা, পাতিনেতাদের প্রচন্ড প্রভাব, প্রতিপত্তি। আমরা পারিবারিকভাবে কখনই আওয়ামীলীগ রাজনীতিতে বিশ্বাসী নই। আমরা প্রায় সবাই ভাসানী ন্যাপের রাজনীতির আদর্শে প্রভাবান্বিত এবং বামপন্থি প্রগতিশীল রাজনীতির সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িত। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সাথে সাথে এলাকার অনেকেই আওয়ামীলীগার হয়ে গেল। আমি একটা জিনিষ লক্ষ্য করলাম আমাদের পরিবারের কেউ মূল রাজনীতির আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে আওয়ামীলীগের রাজনীতির সাথে যোগ দেয়নি। এতে আমি কিছুটা স্বস্তিবোধ করি।
আওয়ামীলীগের একটি প্রভাবশালী অংশ হঠাৎ করে আমাদের কলেজটির নাম জেনারেল ওসমানীর নামে করার প্রস্তাব করেন। আমাদের পরিবার এবং এলাকার অনেকেই সে প্রস্তাব মেনে নিতে পারেন নি। তখনকার দিনে আওয়ামীলীগের এ প্রস্তাবের বিরুদ্ধে রুখে দাড়ানোর ক্ষমতা অনেকেরই ছিল না। আমার মামা আজহার আলীর দেয়া জায়গাতে কলেজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবেন জেনারেল ওসমানী। আমি ঐ উত্তপ্ত সময় এলাকায় স্থান করার কারনে আমাদের সমমনা যুবকরা বিশেষ করে আমাদের পরিবারের সকলেই একত্রিত হয়ে আলোচনায় বসলাম। আমার শ্রদ্ধেয় মামা রীতিমত তখন বিব্রত, সন্দিহান, হতাশায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন। আমাদের নেতা কমরেড আসাদ্দর আলীও আমাদের সাথে ঐক্যমত পোষণ করে যে কলেজের নাম হবে আমাদের এলাকার নামে, অর্থাৎ “তাজপুর কলেজ”। তাজপুর কলেজের প্রথম ব্যাচের ছাত্র তখন আলী নূর ভাই। আমি দেখলাম উনার নেতৃত্বে এলাকার ছাত্র-যুবকরাও কলেজের নাম এলাকার নামে করতেই উচ্চকন্ঠ।
আমার জন্য তখন ঐ পরিস্থিতিটা ছিল বেশ সংকটময়। আমার আদর্শের রাজনীতির প্রতিপত্তি এলাকাতে তখন অনুপস্থিত। আমি অনেকদিন থেকে বিলেতে ছিলাম। আমার আগের সংযোগ যোগাযোগ বর্তমানে তেমন নেই। এছাড়া আমাকে একটু সাবধানে এগুতে হয়েছিল। আমার একমাত্র শক্তি আমার নেতা কমরেড আসাদ্দর আলী, আমার পরিবারের লোকজন ও আমার এলকাবাসী। তবে আমার এক সময়ের রাজনৈতিক সহকর্মীরা যারা প্রায় সবাই তখন আওয়ামীলীগার, তাদের সাথে সেই ব্যক্তিগত সম্পর্ককে তখন আমি কাজে লাগাই। আলী নূর ভাইদের নিয়ে যুব সম্প্রদায়ের সাথে আমি অনেক ছোট ছোট ঘরোয়া সভা ও গণসংযোগ করি। এতে অনেক কাজ হয়। সমাজে আলোচনা আরম্ভ হয়ে যায়, আজহার আলীর এতবড় ত্যাগ তিতিক্ষাকে মূল্যায়ন করা হচ্ছে না।
কলেজ প্রতিষ্ঠার প্রথম দিকে আমার মামা াইলে উনি এত জায়গা জমি কলেজের নামে দেয়ার আগে কলেজের নামকরন কি হবে সেটা নির্ধারণ করে শর্ত জুড়ে দিতে পারতেন। পরিবারের অনেকেই তাকে সে পরামর্শ দিয়েছিলেন। তখন আমার মামাই কলেজের নাম তাজপুর কলেজ হতে হবে বলে সবাইকে বুঝিয়ে বলেন। উনি আমাকে বলেছিলেন যে, আমাদের নামইতো তাজপুর। তাজপুর কলেজ নাম দিলেই আমাদের সবকিছু কভার হয়ে যাবে। উনি যুক্তি দিয়ে বলেছিলেন যে, মানুষ জীবিত থাকতে কারো নামে কোন প্রতিষ্ঠান হওয়া উচিৎ নয়। কারণ ঐ ব্যক্তি মৃত্যুর আগে হয়তো এমন কোন খারাপ কাজ করে যাবে যার জন্য উক্ত প্রতিষ্ঠানের নাম আবার পরিবর্তন করতে হবে। উনার এই প্রস্তাবকে সম্বল করে আমরা এলাকায় এবং সংশ্লিষ্ট সব জায়গায় প্রচার চালিয়ে মানুষের সহানুভূতি আমাদের পক্ষে অনেকটা নিয়ে আসতে সক্ষম হই। তখনকার দিনে আওয়ামীলীগর বিরুদ্ধে এমন কোন উদ্যোগ নেওয়া সত্যিই দুরুহ ছিল। আওয়ামীলীগের জনপ্রিয়তা তখন তুঙ্গে এছাড়াও এলকায় ওসমানী সাহেব অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন। ভিত্তি প্রস্তর স্থাপনের দিন দেখা গেল আওয়ামীলীগাররা রাতে কলেজের নির্ধারিত স্থানে এম এ জি ওসমানী কলেজ নাম দিয়ে একটি গেট তৈরী করে ফেলেছেন। অতি ভোরে এ খবর পাওয়ার পর আমাদের পরিবারের ও আমাদের এলকার লোকজন ও আলী নূর ভাইয়ের নেতৃত্বাধীন কলেজের ছাত্ররা জড়িত হয়ে সিদ্ধান্ত নেয় যে আমরা উক্ত গেট সরিয়ে সেই জায়গায় “তাজপুর কলেজ নাম” দিয়ে গেট করবো। সিদ্ধান্তের সাথে সাথে দল বেধে ওসমানী সাহেবের আগমনের আগেই আমরা নতুন নামে গেট করে ফেললাম।
ভাগ্যবশত: এলাকায় ময়-মুরুব্বীরা ও শান্তিপ্রিয় মানুষের অংশগ্রহণে নিশ্চিত ঝগড়া বিবাদ থেকে আমরা রেহাই পেয়ে যাই। ওসমানী কলেজ নামকরণের প্রন্তাব প্রত্যাহার করার জন্য কাজ আরম্ভ হয়ে যায়। ওসমানী সাহেব যখন নির্ধারিত স্থানে ভিত্তি প্রস্তর স্থানে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করার জন্য উপস্থিত হন তখন কলেজের নামকরণ নিয়ে এ সমস্ত ঝগড়া ঝাটির কথা শুনতে পান। উনি অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হন এবং জানতে চান কারা তাজপুর কলেজের নাম পরিবর্তন করে তার নাম দিতে চায়। তিনি এই অবস্থায় প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের হুকুম করেন যারা “তাজপুর কলেজ” নাম করতে বাধা দান করে তাদেরকে যেন গ্রেফতার করা হয়। তখন আমি আওয়ামীলীগের কিছু নেতা এবং পাতি নেতাদের চুপসে যাওয়া অবস্থা দেখে সুত্যিই আনন্দিত হয়েছিলাম। ওসমানী সাহেবের উদার ব্যক্তিত্বের জন্য আমার মন তাঁর প্রতি শ্রদ্ধায় ভরে উঠে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে এ ধরনের মারাত্মক সামাজিক সমস্যা সমাধানের নেপথ্যে সক্রিয় কার্যক্রম গ্রহণ করেন আমার মহান নেতা কমরেড আসাদ্দর আলী
আসাদ্দর আলী সাহেবের সাথে সম্পর্ক থাকার কারণে আমি বাংলাদেশের জাতীয় পযর্যায়ের বেশ কয়েকজন প্রগতিশীল নেতার সাথে ঘনিষ্ট হওয়ার সুযোগ পাই। তাদের মধ্যে কমরেড তোয়াহা, কমরেড আব্দুল হক, হাজী দানেশ, বিশেষ করে মজলুম জননেতা মৌলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর সাথে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় ঘটে। আমি বিলেত প্রবাসী হওয়ার পর স্বাভাবিক ভাবেই আমার কাছে তুলনামূলকভাবে অর্থের প্রাচুর্য ছিল। আমি একটা ব্যাপারে লক্ষ্য করতাম তার সাথে যতবার আমার দেখা সাক্ষাৎ হতো ততো বারই আসাদ্দর ভাই আমার কাছ থেকে কিছু টাকা চেয়ে নিতেন এবং বেশীর ভাগ সময়ই আমাকে দিয়ে ত্যাগী গরিব ও দরিদ্র নেতা নেত্রী ও কর্মীদের জন্যে ঐ টাকা ব্যয় করিয়ে নিয়ে তৃপ্তি বোধ করতেন। এক দিনের ঘটনা আমি আজও ভুলতে পারিনি। আমি নানাকে নিয়ে ঢাকায় হোটেল সোনারগাঁয়ে কয়েকদিন তার সাথে সময় কাটানোর প্রস্তাব করি। আমার প্রস্তাব করার কারণও ছিল। আমি জানি নানা কোনদিনই টাকা ব্যয় করে এ জাতীয় হোটেলে উঠবেন না। এর পরিবর্তে তিনি ঐ টাকা গরিবদের পিছনে খরচ করতে পছন্দ করতেন বেশী। আমি তার সাথে দিনের পর দিন আলাপ আলোচনা করে তৃপ্তি লাভ করতাম। আমকে সঙ্গ দিতে পেরে তিনিও যে আনন্দ লাভ করতেন তা আমি উপলব্ধি করতে পারতাম। আমার প্রস্তাব শুনে তিনি আঁৎকে উঠলেন। আমার কাছে জানতে চান তাঁকে নিয়ে হোটেল সোনারগাঁয়ে থাকতে কত খরচ হবে। আর আমার এ জাতীয় প্রস্তাবের কারণ কি? আমি তাকে বিনয়ের সাথে জানালাম তিনি যে রকমের মিতব্যয়ী তিনি কোনদিনই এ জাতীয় হোটেলে উঠবেন না এবং উঠতে চাইবেনও না। আমার ইচ্ছা ছিল যে ফাইভ ষ্টার হোটেলের তার কিছু অভিজ্ঞতা হোক। তার জন্যে কিছু করতে পারলে আমি নিজে শান্তি পাবো। আর এ কারণেই আমার প্রস্তাব। তিনি বিনয়ের সাথে আমাকে বললেন ‘সালিক’ ফাইভ ষ্টার হোটেলে থাকার অভিজ্ঞতা আমার চীন সফরে হয়েছে। সুতরাং যে টাকা আমার পেছনে খরচ করতে চাও বরং তা আমাকে দিয়ে দাও। টাকা তার হাতে দেওয়ার পর তিনি আমাকে সাথে নিয়ে ঢাকার বিখ্যাত মিষ্টির দোকান মরনচাঁদে ঢুকলেন। তার হাবভাবে আমার কাছে মনে হলো দোকানের সমস্ত মিষ্টি কিনে নেবেন। মনের আনন্দে ৩/৪ ভাগ করে মিষ্টি কিনে আমাকে নিয়ে গাড়ী করে প্রথমেই বাংলাদেশের বিশিষ্ট সাংবাদিক, তার ভক্ত অচিন্ত্য সেন ও তা সহধর্মিনী দীপাদির হাতিরপুলের বাসায় গেলেন। এরপর কমরেড তোয়াহা সহ বেশ কয়েকটি বাসায় আমাকে নিয়ে মিষ্টি বিতরণ করে আত্মতৃপ্তিতে আমাকে ধন্যবাদ দিয়ে কত যে আনন্দিত হয়েছিলেন। আমার এখনও বেশ মনে পড়ে সেদিন আমাকে বলে ছিলেন, “তোমার অচিলায় আমি এদেরকে মিষ্টি বিতরণ করে তাদের জন্যে ব্যতিক্রমি এক্সপিরিয়েন্স দিতে পারলাম। তাদের টানাটানির সংসারে সব সময় এভাবে মরনচাঁদের মিষ্টি উপভোগ করার সুযোগ পায়না”। তার সাথে এ জাতীয় অনেক ঘটনার স্মৃতি আজও আমার স্মৃতির মণিকোঠায় ভাস্বর। শুধু তাই নয়। অধ্যক্ষ সুধীর চন্দ্র পালের সাথে ছিল তার খুবই সখ্যতা।  সুধীর পালের টানাটানির সংসার, আমি বিলেত থেকে দেশে গেলেই আমার কাছ থেকে কিছু টাকা চেয়ে নিতেন ও বলতেন “চল এক জায়গা থেকে একটু ঘুরে আসি” এভাবে আমাকে নিয়ে সোজা চলে যেতেন সুধীর পালের বাসায়। আসার সময় বলতেন ঐ টাকাগুলো রেখে দেন। আমার মনে হয় ঐ ভাবে দরিদ্র ও জ্ঞানীদের সাহায্য করে তিনি আনন্দ পেতেন। আরো বহু পরিবারকেই তিনি এভাবে সাহায্য করতেন।
আরও একদিনের একটি ঘটনা এখানে উল্লেখ করতে চাই। তিনি যে কত বড়ো মাপের মানুষ ছিলেন তা এ থেকে সহজেই বুঝা যাবে। ১৯৮৬ সালে আমি যখন স্বপরিবারে স্থায়ী ভাবে বসবাসের জন্য বাংলাদেশে যাই তখন নানা নানীকে নিয়ে প্রায়ই আমাদের বাড়ীতে আসতেন। সমস্ত আমরা গল্প-গুজব ও গান বাজনার মধ্য দিয়ে কাটিয়ে দিতাম। একদিন সকালে চা নাস্তার পর আমার গাড়ীতে করে নানা ও নানীকে নিয়ে প্রায়ই আমাদের বাড়ীতে আসতেন। সমস্ত রাত্রি আমরা গল্প-গুজব ও গান বাজনার মধ্য দিয়ে কাটিয়ে দিতাম। একদিন সকালে চা নাস্তার পর আমার গাড়ীতে করে নানা ও নানীকে নিয়ে আমাদের ইলাসপুরের নতুন বাড়ী থেকে কাজির গাঁয়ে নানাদের বাড়ী যাচ্ছিলাম। ঐ সময় তাজপুর বাজারের কাছে উনার একখন্ড মূল্যবান ভূমিতে কয়েকজন লোককে মাটি কাটতে দেখতে পাই। নানা আমাকে গাড়ী থামাতে বলেন, আমি গাড়ী থামিয়ে দিলাম ও সাথে সাথে গাড়ী থেকে নেমে যাই। আমারে মাধ্যমে তিনি ঐ লোকদের কাছে জানতে চান, তার জমিতে এরা কি করছে। আমি সেখানে তাজপুরের কিছু ভূমিখেকো দালালদেরও দেখতে পাই। তারা আমাকে জানায় যে ঐ জমির মালিক তারা। অথচ যুগ যুগ ধরে আসাদ্দর ভাইরা এ জমি বিনে দলিলে খরিদের মাধ্যমে ভোগ করে আসছিলেন। তাদের উত্তর শুনার পর হতবাক হয়ে কি করতে হবে তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করেন। আমি তাদের ঐ জমিতে কাজ বন্ধ করার জন্যে বলি এবং কাজ বন্ধ করে দেই। এটা করতে গিয়ে তাদের সাথে আমার বেশ কথা কাটাকাটি হয়। দেখা দেয় মনোমালিন্য। স্থানীয় ভাবে ঐ লোকগুলো ক্ষমতাশালী ছিল। আমি তাদের স্পষ্ট জানিয়ে দেই তাজপুর এলাকাতে কমরেড আসাদ্দর আলী সাহেবের কথাই হল দলিল। কেউ যদি উনার সম্পত্তি দখল করতে আসে আমি তা প্রতিরোধ করবো। আসাদ্দর আলী এবং তাঁর ভাইয়েরা সকলেই ছিলেন সরল প্রকৃতির মানুষ। তারা যে কোন জনকে বিশ্বাস করতেন। অনেক জমি তাঁরা খরিদ করেছেন কোন দিনই কাগজ করেননি। এভাবে দেখা গেছে তাদের সরলতার সুযোগে অনেকেই তাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। এরপর ঐ জমি সংক্রান্ত ব্যাপারে এলাকাতে লোকজনদের নিয়ে বৈঠক করতে গিয়ে দেখি আসাদ্দর ভাইয়া সত্যিকারের মালিক হলেও তাদের বৈধ কোন কাগজ-পত্র নেই। তাদের সরলতার সুযোগে ভূমিখেকোরা পূর্ববর্তী মালিকদের নামে জাল দলিল সৃষ্টি করে ফেলেছে। আমি এবং হিতাকাক্সক্ষীরা গৌছ ভাই সহ উনার এই ঝামেলা সমাধান করতে গিয়ে যাতে কোন সমস্যায় না পড়ি এ ব্যাপারে তার চিন্তা ছিল। তার মাঝে সবুর ছিল প্রচুর এবং তিনি ঝগড়া ফ্যাসাদ পছন্দ করতেন না। তাদের এই নায্য বিষয়ে এলাকার সকলেই তাদের জন্য লড়তে প্রস্তুত। তারা সকল সময়ই নিরীহ প্রকৃতির মানুষ, মামলা-মোকদ্দমা তারা পছন্দ করতেননা। আমি যাতে এনিয়ে ঝামেলায় না জড়াই এ ব্যাপারে তাঁর যত ব্যাকুলতা। তিনি বললেন, আমার জমি চলে যায় যাক। তুমি ঝগড়া ঝাটিতে যেওনা। আইন বা সামাজিক প্রতিপত্তির অভাব ছিলনা তাঁর। তিনি বললেই তাঁর পক্ষে লোকজন আসতো, প্রশাসনও তাঁকে সহযোগিতা করতো। তিনি চাইলে ঐ ভূমি দস্যুদের একেবারে শেষ করে দিতে পারতেন। তিনি এসবের ধার ধারেননি। আমি যতদিন বাংলাদেশে ছিলাম ঐ ভূমিখেকোরা আর আসেনি। আমি লন্ডন চলে আসার পর শুনেছি ঐ ঝামেলাপার্টির সাথে তার একটা আপোস মীমাংসা হয়ে যায়।
আমি উনাকে দুইবার লন্ডন আনিয়েছি।
প্রথমবার, ১৯৮২ সালে তার বিলেত সফরের সময় তিনি সিলেটের বিশিষ্ট শ্রমিক নেতা মতছির আলী ওরফে কালা মিয়া কে সঙ্গে নিয়ে আসেন। তাঁরা বিভিন্ন জায়গায় রাজনৈতিক সভা-সমিতিতে যোগদান করেন। বিশেষ করে, লন্ডনে বসবাসরত স্কারগীল, পিটার শো এমপি, টনি বেন এমপি, ডান জোন্স প্রমুখ বামপন্থি নেতাদের সাথে সাক্ষাৎ করেন। এছাড়া তিনি লন্ডনস্থ চীনা রাষ্ট্রদূতের সাথেও দু’বার বৈঠকে মিলিত হন। তিনি গ্রীক দার্শনিক সক্রেটিসের ভাষায় বলতেন, “আমি শুধু একজন বাংলাশেী নাগরিক নই, আমি বিশ্বের নাগরিকও বটে।”
দ্বিতীয় বার, ১৯৮৪ সালে তিনি সাথে নিয়ে আমার মামা প্রবীণ বিলাত প্রবাসী কমরেড আজহার আলীকে। সে সফরে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক যোগাযোগ ছাড়াও তাঁদের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল তাজপুর কলেজের জন্য চাঁদা সংগ্রহ করা। আমি তাঁদের নিয়ে লন্ডনের বিভিন্ন এলাকা, বার্মিংহাম, কভেন্ট্রি, মাঞ্চেষ্টার, ব্রাডফোর্ড, লিডস, লুটন, সেন্ট আলবান্সসহ বহু শহরে আমাদের তাজপুর এলাকাবাসীর কাছে তাজপুর কলেজের সাহায্যার্থে অনেকগুলো সভায় মিলিত হই। ফলে তাঁরা আমাদের কলেজের জন্য বহু লক্ষ টাকা নিয়ে যান।
সর্বোপরি আমি এখানে বলতে চাই কমরেড আসাদ্দর আলী আমার চিন্তায় চেতনায় একজন অতি বড় মাপের রাজনীতিবিদ, মানবদরদী সমাজকর্মী ছিলেন। তাঁর মৃত্যু আমাকে ব্যক্তিগতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। আমার জীবনে যে কোন সমস্যায় তাঁর যে অবদান ছিল তা আমি কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করছি। তিনি জীবিত থাকলে দেশ-জাতি-সমাজ এবং আমার মতো অনেকেই ব্যক্তিগতভাবে উপকৃত হতেন। কমরেড আসাদ্দর আলীকে আমরা যারা শ্রদ্ধা করতাম, তাঁর সাথে রাজনীতি করতাম, তাঁর মৃত্যুর পর তার ত্যাগ তিতিক্ষাকে লিপিবদ্ধ করার এবং ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্যে তুলে ধরার দায়িত্ব আমাদের বেশী। সুচারুরুপে তাঁর প্রকৃত জীবনালেখ্য তুলে ধরতে পারলে সমাজ জাতি এই আদর্শবান ব্যক্তিত্বকে জেনে উপকৃত হবে। আমি প্রায়ই তাকে গুণ গুণ করে গাইতে গাইতে শুনতাম ‘গাহি সাম্যের গান/মানুষের চেয়ে নহে কিছু বড়/নহে কিছু মহীয়ান।’ এ কথাগুলির উদ্বৃতি দিয়েই তাঁর প্রতি আমার শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।

মোহাম্মদ আব্দুস সালিক : লন্ডনে একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী, শিক্ষানুরাগী, বালাগঞ্জ এডুকেশন ট্রাষ্টের প্রতিষ্ঠাতা সেক্রেটারী ও পরে চেয়ারম্যান এবং লন্ডন দিশারী শিল্পীগোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা।

Post a Comment

কমরেড আসাদ্দর আলী বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় নাম।তিনি সারাজীবন মেহনতী মানুষের কল্যানে কাজ করে গেছেন।১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে তার অবিস্মরণীয় অবদান ছিল।তিনি কমিনিষ্ট আন্দোলনের পথিকৃত এবং বাংলাদেশের সাম্যবাদী দলের সাবেক সভাপতি ছিলেন।গণ মানুষের নেতা কমরেড আসাদ্দর আলীর স্বরনে একটি ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা মাত্র।সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ।

Emoticon
like dislike :) ;(( :-) ;-( :d :o :>) (o) [-( :-? (f) x-) (k) (h) (c) cheer
Click to see the code!
To insert emoticon you must added at least one space before the code.