Feature Label 3

0

comrade assador ali
গত শতকের পঞ্চাশের দশক। মুরারি চাঁদ কলেজে পড়ার নামে সিলেট শহরে দাপিয়ে বেড়াই। বিচরণের প্রধান ক্ষেত্র সাহিত্য-সংস্কৃতি। তার সঙ্গে কিছু রাজনীতি। এ সূত্রেই আসাদ্দর আলী সাহেবের সঙ্গে পরিচয়। আওয়ামীলীগের আড়ালে তিনি তখন কম্যুনিস্ট পার্টির সার্বক্ষণিক কর্মী। যতদূর মনে পড়ে জিন্দাবাজারে আওয়ামী লীগ অফিসেই থাকতেন। আসাদ্দর আলী আর হবিবুর রহমান (পরে পীর হবিবুর রহমান)। তখন তারা দুই সহযোদ্ধা এবং অভিন্ন হৃদয় বন্ধু। আলাদা ওদের কমই দেখেছি। ওর সঙ্গে মাঝে মধ্যে দেখা হতো বন্দর বাজারের দিকে।
এটা-ওটা নানা কিছুতে যুক্ত থাকলেও আমার প্রধান আকর্ষণ তখন কবিতা। আসাদ্দর আলীও কবিতা লিখতেন কেনো এক সময়। অনেকের কাছে তিনি ‘কবি সাহেব’ নামেই ছিলেন পরিচিত। নিজের কোনো কবিতা কখনো শুনিয়েছেন, এমন মনে পড়ে না। তবে কথায় কথায় সুকান্ত-সুভাষ আউড়ে যেতে পারতেন। যেতেনও। তার উপর সব সময়ই ছিলেন হাসিমুখ। কৌতুকে উজ্জ্বল এবং সময় বিশেষে উচ্ছ্বলও। এমন একজন মানুষ বয়েসে বড় হলেও বন্ধু হতে আটকায় না। আমিও সিলেট রক্ষণশীলতার গতি অতিক্রম না করেও সহজেই তার বন্ধু স্থানীয় হয়ে উঠলাম। নানা কারণেই এ সম্পর্ক দীর্ঘস্থায়ী হতে পারেনি। এর একটা বড় কারণ আমার সিলেট বাসের একটা বড় অংশ তাকে অজ্ঞাতবাসে কাটাতে হয় আইয়ুবি জঙ্গী শাসনের ফলে। অন্য কারণ সম্ভবত এই যে, গোড়ায় তিনি আমাদের বন্ধু গণমানুষের কবি দিলওয়ারের গভীর অনুরাগী হলেও এক সময় ওদের মাঝে একটা দুরত্ব বর্তে যায়। আমরাও যেনো কিছুটা দূরের মানুষ হয়ে উঠি। তার অর্থ অবশ্য এই না যে, আমাদের সম্পর্কের ওখানেই ইতি ঘটে।
আসাদ্দর আলী যে আমাকে একদম ভুলে যাননি তার প্রমাণ পাই ঊনিশ শ পঁয়ষট্টি/ছেষট্টি সালে। সিলেট থেকে বি.এ পাশ করার পর দু’বছর পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে কাটিয়ে তেষট্টির শেষ দিক থেকে ঢাকাই আমার আস্তানা। সিলেটের সঙ্গে যোগাযোগ অনেকটাই ক্ষীণ। আসাদ্দর আলীর সঙ্গেও কোনো যোগাযোগ ছিলো না। হঠাৎ একদিন তিনি এসে হাজির হলেন আমার বাসায়। জানালেন ক’দিন থাকবেন। আমি খুবই খুশি মনে স্বাগত জানালাম। অসুবিধেও কিছু ছিল না। সিদ্দিক বাজারে একটা বাসা নিয়ে আমি তখন একাই থাকি। এই থাকা নিয়ে বেশ একটা মজার ঘটনা ঘটে।
হয়েছে কি আমি তখন এক জোড়া বেড়াল পুষেছিলাম। নাম দিয়েছিলাম ‘সাহেব’ আর ‘বিবি’। সাহেব-বিবির সঙ্গে আমার মাখামাখি দেখে আসাদ্দর আলী আ॥কে উঠলেন- এ্যা, তোমার ঘরো দুই-দুইটা বিলাই, তে তো আমার থাকা চলতো না। বেড়ালে আপত্তি কেন, জানতে চাইলে বললেন, ওরা চোরের জাত। খাবারে মুখ দেবেই। বেড়ালের যেখানে এমন আসকারা সেখানে থাকতে তাই তার ঘোর আপত্তি।
আমি বললাম, যেতে হয় দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর যাবেন। এক বেলায় তেমন অঘটন কিছু ঘটবে না।
উনি রাজি হলেন। আর আমি তাকে জব্দ করার একটা ফন্দি আটলাম। গোসলে যাওয়ার আগে কাজের ছেলে অনুকে বলে গেলাম টেবিলে খাবার লাগানোর বদলে বারান্দায় মাদুর পেতে খাবার দিতে। পুরানো দিনের একতলা দালান। তার বারান্দা ছিল বেশ চওড়া। খাওয়া-শোষা সবই চলতো।
আসাদ্দর আলী যখন গোসল সেরে ফিরলেন তার বেশ আগেই বারান্দার মাদুরে খাবার দেওয়া হয়ে গেছে। আমি একটু দূরে বসে একটা বই’র পাতা ওল্টাচ্ছিলাম। আর সাহেব-বিবি বেড়াল দুটি ম্যাও-ম্যাও করে প্রতিবাদের ঝড় তুলে মাদুরটার চারপাশে ঘুরছিল। আসাদ্দর আলী চোখ বড় বড় করে ওদের দেখছিলেন। জানতে চাইলেন খাবারে মুখ না দিয়ে বেড়াল দুটো অমন করছে কেন।
মাদুরের কাছেই রাখা দুটো থালা দেখিয়ে বললাম, ওদের থালায় খাবার দিলেই ওরা খাবে। এভাবে শিখিয়েছি। খাবার দেয়া হয়নি বলেই ওরা এভাবে প্রতিবাদ জানাচ্ছে। আমার কথা শুনে আর বেড়াল দুটোর কান্ড দেখে তিনি অস্থির হয়ে উঠলেন- না, না, এভাবে কষ্ট দেওয়া অন্যায়। তোমার বিলাইরে আগে খাবার দেও। বললেন খাবার দিতে কিন্তু নিজেই মাছ-ভাত মাখিয়ে বেড়ালের থালায় উঠিয়ে দিতে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন।
তার দরদী মন বুঝি বিড়াল দুটোর কষ্টও সইতে পারছিল না।
এক ফাঁকে বলে রাখা ভালো, বেড়ালকে এভাবে সংযম শেখালেও দীর্ঘদিন তারা সে সংযম বা শিক্ষা ধরে রাখতে পারে না। ওদের মগজের ধারনক্ষমতা কম বলেই দু-তিন দিনের অনিয়মে সব শিক্ষা ভুলে যায়।
বলছিলাম আসাদ্দর আলীর দরদী মনের কথা। বিড়ালের কষ্ট যিনি সইতে পারেন ন, স্বজাতি মানুষের দুঃখ কষ্ট তিনি সইবেন কি করে? চারপাশের দুঃখ-কষ্টের ছবি দুর্বিসহ ঠেকেছিল বলেই তিনি সুখি জীবনের বাঁধা পথ ছেড়ে সর্বহারা মানুষের কল্যাণ কামনায় নিজের জন্য কঠিন সংগ্রামের পথ বেছে নিয়েছিলেন। সরকারি চাকরির নিরাপত্তা স্বেচ্ছায় ত্যাগ করে কম্যুনিস্ট পার্টির সার্বক্ষণিক কর্মীর কৃচ্ছ্র জীবন বরণ করে নিয়েছিলেন। সুকঠিন যাত্রায় ত্যাগ করেছিলেন ভালো লাগার জগৎ কবিতাকেও (পরবর্তী জীবনে কবিতা লিখেছেন বলে জানি না)।
আসাদ্দর আলী সাহেব এভাবে আমার বাসায় এসে ওঠার কারণ পরে আন্দাজ করেছিলাম। পার্টি তখন ভেঙে দু টুকরো হয়ে গেছে। এক টুকরো চৈনিক পন্থাকেই যথার্থ বলে মেনে নিয়ে আলাদা। আসাদ্দর আলীও ছিলেন সে দলে। স্বভাবতই তার প্রিয় শিষ্য অচিন্ত্য সেন দল বদলাবে এটাই তিনি চাইলেন। মেধাবী শিক্ষার্থী অচিন্ত্য সেন তখন জগন্নাথ হলে থেকে রসায়ন শাস্ত্রে অনার্স পড়ছিলেন। আসাদ্দর আলীর অনুপ্রেরণায় পড়াশুনার চাইতে রাজনীতিই তখন অচিন্ত্যর কাছে বড়। হলে পুরোনো বন্ধুদের মাঝে বাস করে দল বদলানো কঠিন। অচিন্ত্যর তাই সাময়িক ভাবে হলেও আস্তানা বদলানো দরকার হয়ে পড়েছিল। আমার বাসাটা তার অনুকূল হবে কি না যাচাই করতেই সম্ভবত তিনি আমার অতিথি হন। এর দিন কয়েক পরেই অচিন্ত্য আমার বাসায় এসে উঠেন। এরপর তার পরিবর্র্র্র্র্তন থেকে আমার পূর্বোক্ত আন্দাজ। আজো মনে করি এ আন্দাজে আর যাই হোক ভুল করিনি।
রাজনীতিতে নেমে আসাদ্দর আলী এক কঠিন পথ অবলম্বন করেছিলেন। তার সে রাজনীতির পরিণাম কি সে বিবেচনার চেয়ে আমার কাছে এ সত্যটাই বড় যে, ভালো চেয়েছেন এবং এ জন্যে যা ভালো মনে করেছেন আজীবন ছিলেন সে পথেরই অনুসারি। কোনো প্রলোভন তাকে পথচ্যুত করতে পারেনি। প্রিয় বন্ধুদের সান্নিধ্য অবলীলায় ছাড়লেও বিশ্বাসের সঙ্গে কখনো বেঈমানী করেননি। করেননি কখনো অন্যায়ের কাছে মাথা নত। এখানে এসেই তিনি জীবনজয়ী।
দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে আজ যখনই তাকে মনে পড়ে, মনের পর্দায় ভেসে ওঠে পুরানের দধিচির নাম। যুদ্ধকে ন্যায় বলে মানলে সে যুদ্ধে আয়ুধের চাহিদা মেটাতে যে দধিচিরা অনায়াসে নিজ হাড় দিয়ে দিতে পারে।
আসাদ্দর আলী এভাবেই নিজ বিশ্বাসের সংগ্রামে পুরো জীবনটাই দান করে গেছেন কোনো প্রতিদানের প্রত্যাশা না-রেখে। স্বপ্ন আমরা সকলেই কমবেশি দেখি। কিছু সংগ্রামের সংকল্পও আমাদের অনেকের মনেই জাগে। কিন্তু জীবনের অন্যবিধ দাবির মুখে স্বপ্ন আর সংকল্প আঁকড়ে থাকার সাধ্য আমাদের হয় না। আসাদ্দর আলীরাই তা পারেন। আর এ জন্যেই তার স্মৃতির প্রতি হাজারো সালাম।

সালেহ চৌধুরী : প্রবীন সাংবাদিক, মুক্তিযোদ্ধা ও লেখক

Post a Comment

কমরেড আসাদ্দর আলী বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় নাম।তিনি সারাজীবন মেহনতী মানুষের কল্যানে কাজ করে গেছেন।১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে তার অবিস্মরণীয় অবদান ছিল।তিনি কমিনিষ্ট আন্দোলনের পথিকৃত এবং বাংলাদেশের সাম্যবাদী দলের সাবেক সভাপতি ছিলেন।গণ মানুষের নেতা কমরেড আসাদ্দর আলীর স্বরনে একটি ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা মাত্র।সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ।

Emoticon
like dislike :) ;(( :-) ;-( :d :o :>) (o) [-( :-? (f) x-) (k) (h) (c) cheer
Click to see the code!
To insert emoticon you must added at least one space before the code.