Feature Label 3

0

কমরেড আসাদ্দর আলী স্মৃতি পরিষদ,কমরেড আসাদ্দর আলী,আসাদ্দর আলী,কমরেড আসদ্দর আলী,আসদ্দর আলী,কমরেড আছদ্দর আলী,আছদ্দর আলী,জুবায়ের সিদ্দিকী,ব্রিগেডিয়ার জুবায়ের সিদ্দকী,comrade asaddar ali,asaddar ali,comrade assador ali,assador ali,jubear siddique,scholarch home ,sylhet

জীবনে চলার পথে হাজারো মানুষের সংস্পর্শে আসার সুযোগ হয়। কারো কারো কথা মনে চিরস্থায়ী হয়ে থাকে আবার অনেকের স্মৃতি হয় ক্ষণস্থায়ী এবং বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যায় স্বল্প সময়ের মধ্যেই। জনাব মরহুম আসাদ্দর আলী এমনই এক ব্যক্তি ছিলেন, যার স্মৃতি এত বছর পর এখনো অম্লান হয়ে আছে। পরিচয় অবশ্য সরাসরি আমার সাথে হয়নি, হয়েছিল আমার পিতার মাধ্যমে। আমার পিতা মরহুম শাহ্ তজম্মুল আলী সিদ্দিকী ষাটের দশকের শুরুতে দুর্গাকুমার পাঠশালার প্রধান শিক্ষক হিসাবে কর্মরত ছিলেন। সেই সময় ১৯৬১-৬২ সালে মরহুম আসাদ্দর আলীর সাথে আমার পিতার ঘনিষ্ট সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আমি ঠিক জানিনা উনাদের মধ্যে কোন মৌলিক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য পরস্পরকে কাছে টেনে নেয়ার জন্য পরস্পরকে আকৃষ্ট করেছিল। তবে একটা কথা নিশ্চিতভাবে জানি, কোন রাজনৈতিক মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে এই সম্পর্ক গড়ে উঠেনি। কারণ আমার পিতা কোন প্রকার রাজনীতি বা রাজনৈতিক মতাদর্শে মোটেই আগ্রহী ছিলেন না, অপর দিকে জনাব মরহুম আসাদ্দর আলী বাম রাজনীতিতে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। সম্ভভবত মানুষ হিসাবে চারিত্রিক গুণাবলীর মিল থাকায় তাদের মধ্যে ঘনিষ্ট সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।
আমি তখন একেবারেই একজন কিশোর।। ১৯৬২ সনে সবেমাত্র ৮ম শ্রেণীর ছাত্র। তবে বাবার সু-সম্পর্কের সুবাদে মরহুম আসাদ্দর আলীর কাছ থেকে পেয়েছি সন্তানতুল্য স্নেহ এবং অকৃত্রিম ভালবাসা। মনে আছে ঈদের সময় আমাকে নিয়ে দর্জির দোকানে মাপ দিয়ে আমার জন্য একটি জামা তৈরী করে উপহার দিয়েছিলেন। আমার বাবাও সেটা জানতেন না। এটা সে সময় আমার ভাই-বোনের হিংসার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। শহরের শাহী ঈদগাহর কাছে বাদামুরায় আমার পিতা ও মরহুম আসাদ্দর আলী কিছু জমি কিনেছিলেন। সে ১৯৬৩ সনের কথা। ময়মনসিংহ থেকে আব্দুল আহাদ নামে এক দরিদ্র ব্যক্তিকে সেখানে নিয়ে এসে ছিলেন। শুধু যে তাকে এবং তার পরিবারের জন্য ঘরই তৈরী করে দিয়েছিলেন তাই নয়- তাকে জীবিকা নির্বাহের জন্য হাসান মার্কেটে একটি জুতার দোকানও করে দিয়েছিলেন । এমনি করে অনেক দরিদ্র লোকজনকে তিনি নিজের অর্থব্যায়ে জীবিকা নির্বাহের অবলম্বন করে দিয়েছিলেন। তিনি যে কেবল বাম রাজনীতির আদর্শে বিশ্বাসী একজন মানুষ ছিলেন তাই নয় তিনি তার ব্যক্তিগত জীবনে এবং সামাজিক জীবনেও তার রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রতিফলন ঘটিয়ে ছিলেন অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে। নিজে অত্যন্ত সহজ সরল জীবন যাপন করতেন এবং নিজের যা কিছু ছিল তা অকাতরে বিলিয়ে দিতেন অপেক্ষাকৃত কম ভাগ্যবানদের মধ্যে।
পাকিস্তানি আমলে বামপন্থীরা ছিলেন শাসনতন্ত্রের প্রধান টার্গেট। কমিউনিস্ট ভীতি সর্বক্ষণ পাকিস্তানী শাসকদের তাড়া করে বেড়াত। কোন ছুতো পেলেই প্রথমেই বামপন্থি রাজনীতিবিদদের গণহারে গ্রেফতার করা হত। মরহুম আসাদ্দর আলী যে কতবার রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে কারাবরণ করেছেন তার সঠিক কোন তথ্য আমার জানা নেই। তবে প্রায়শঃই তাকে গ্রেফতার করা হত অথবা হুলিয়া মাথায় নিয়ে ঘুরে বেড়াতে হত। প্রায়ই গভীর রাতে সাদা পায়জামা পাঞ্জাবী আর চাদর গায়ে আমাদের বাসায় চুপি চুপি আসতেন। আমাদের বুঝতে অসুবিধা হত না যে উনার বিরুদ্ধে নিশ্চয়ই তখন কোন গ্রেফতারী পরোয়ানা আছে। এটাই তখনকার দিনে উনার জন্য স্বাভাবিক জীবন ছিল। মনে আছে একবার ১৯৬২-৬৩ সালে কারা অভ্যন্তরে অন্তরীণ অবস্থায় ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। জেল থেকে পুলিশ পাহারায় সদর হাসপাতালে তাকে স্থানান্তর করা হয়। বাবা আমাকে নিয়ে উনাকে দেখার জন্য হাসপাতালে গিয়েছিলেন। দরজায় পুলিশের অনুমতি নিয়ে ওয়ার্ডের ভেতরে গিয়ে উনাকে দেখতে পাই। এক হাতের হাতকড়া বেডের সাথে আটকে রাখা হয়েছে। একহাত নাড়াচাড়া করতে পারছেন না। পাশেই বসা রাইফেল হাতে দু’জন সশস্ত্র পুলিশ প্রহরী। পেটের ব্যথায় কষ্ট পাচ্ছিলেন তবুও মুখে হাসি লেগেছিল-কথা বলছিলেন স্বভাববজাত স্নেহের সুরে। হাতকড়া পরা হাতের দিকে তাকিয়ে আমাদেরও খুব কষ্ট হচ্ছিল কিন্তু উনি হেসে হেসে বলছিলেন, ‘এগুলোতো আমাদের গা সওয়া হয়ে গেছে। রাজনীতি করতে গেলে এমন একটু আধটু হয়েই থাকে।’ তখনও সংসার করেননি (অনেক পরে অবশ্য শান্তি ভাবীকে বিয়ে করেছিলেন) তাই জেল থেকে বেরিয়েই আবার সক্রিয় রাজনীতি, আবার জেলে। উনার জীবন চক্র এমনিই চলছিল।
১৯৬৮ সালে পাকিস্তান মিলিটারী একাডেমীতে তখন আমি প্রশিক্ষণরত ক্যাডেট। বাৎসরিক ছুটিতে সিলেট এসে একবার উনার সাথে দেখা করতে গেলাম। সেনাবাহিনী সম্পর্কে অনেক গল্প করেছিলাম উনার সাথে। তখনকার পূর্ব পাকিস্তানে সেনা সংখ্যা, তাদের অবস্থান এবং কর্মক্ষমতা সম্পর্কে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করছিলেন। আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না কেন তিনি এত আগ্রহ নিয়ে এসব জানতে চাইছেন। হঠাৎ করে উনি বললেন ‘পাকিস্তান কিন্তু আর বেশিদিন টিকবেনা। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েই যাবে। খুব বেশী দূরে নয় আমাদের স্বাধীনতা।’ আমি আচমকা যেন শিউরে উঠলাম। কারণ তখন আমরা কেউই পূর্বপাকিস্তান বিচ্ছিন্ন স্বাধীন বাংলাদেশ হিসাবে কোন দিন আত্মপ্রকাশ করতে পারে তা কল্পনাও করিনি। একটি প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ কিভাবে দাঁড়াবে আর কি ভাবেই বা দেশ স্বাধীন করতে পারে তা তখন আমি বুঝতে পারছিলাম না। কিন্তু আসাদ্দর আলীর মত একজন দূরদৃষ্টি সম্পন্ন মানুষই কেবল এমন ভবিষ্যদ্বাণী করতে পেরেছিলেন। এমন দূরদৃষ্টি সম্পন্ন একজন রাজনীতিবিদের সংস্পর্শে আসার সুযোগ ইতিপূর্বে কখনও আমার হয়নি। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ যখন শুরু হয় তখন কেবলই মরহুম আসাদ্দর আলীর ঐ ভবিষ্যতদ্বাণী বার বার আমার মনকে দোলা দিয়েছিল। আমার মনে হয় ১৯৬৮ সালে আমাদের অনেক রাজনীতিবিদরাই বাংলাদেশকে নিয়ে এত গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করেননি বা এমন ভবিষ্যদ্বানী উচ্চারণে সমর্থ ছিলেন না।
মরহুম আসাদ্দর আলীর সাথে সব শেষ দেখা হয়েছিল যখন তখন আমি রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তা বাহিনীতে কর্মরত। তিনি তখন পিজি হাসপাতালে অসুস্থ, প্রচন্ড ব্যথায় কাতরাচ্ছিলেন। একদিন ডিউটির ফাঁকে তাকে একনজর দেখার জন্য পিজি হাসপাতালে গিয়েছিলাম। তার কষ্ট আর বেদনাক্লিষ্ট অবস্থা দেখে আমারও ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তোমার কাছে কি পিস্তল আছে?’ আমি বললাম, হ্যাঁ আছে। ডিউটির ফাঁকে আপনাকে দেখতে এসেছি, কোমরে সাফারী সার্টের নীচে পিস্তল আছে। উনি বললেন, ‘এই কষ্ট আর সহ্য হচ্ছেনা- তোমার পিস্তল দিয়ে একটা গুলি করে আমাকে এই কষ্ট থেকে মুক্তি দাও।’ আমি আমার অশ্র“ সংবরন করতে পারিনি। খানিকক্ষণ তার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে নিরবে প্রস্থান করি । এই ছিল তার সাথে আমার শেষ দেখা। এর কদিন পরেই তিনি সবকষ্ট জ্বালা যন্ত্রণার অবসান ঘটিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নেন।
আমি মরহুম আসাদ্দর আলীকে একজন সহজ সরল কোমল হৃদয়ের মানুষ হিসেবে দেখেছি। আমি একজন আত্মত্যাগী নিরহংঙ্কারী রাজনীতিবিদ হিসাবে তাকে দেখেছি। আমি একজন দূরদৃষ্টি সম্পন্ন গভীর দেশাত্ববোধ সম্পন্ন রাজনীতিবিদ হিসাবে তাকে দেখেছিলাম। যদিও আমাদের যোগাযোগ ছিল অত্যন্ত ক্ষীণ এবং স্বল্প দিনের, তবুও হৃদয়ে তার স্মৃতি এখনও অম্লান হয়ে আছে।

জুবায়ের সিদ্দিকী: বিগ্রেডিয়ার জেনারেল (অব:), অধ্যক্ষ, স্কলার্স হোম, সিলেট ও লেখক।

Post a Comment

কমরেড আসাদ্দর আলী বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় নাম।তিনি সারাজীবন মেহনতী মানুষের কল্যানে কাজ করে গেছেন।১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে তার অবিস্মরণীয় অবদান ছিল।তিনি কমিনিষ্ট আন্দোলনের পথিকৃত এবং বাংলাদেশের সাম্যবাদী দলের সাবেক সভাপতি ছিলেন।গণ মানুষের নেতা কমরেড আসাদ্দর আলীর স্বরনে একটি ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা মাত্র।সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ।