Feature Label 3

0
কমরেড আসাদ্দর আলী স্মৃতি পরিষদ,কমরেড আসাদ্দর আলী পরিষদ,কমরেড আসাদ্দর আলী,আসাদ্দর আলী,কমরেড আসদ্দর আলী,আসদ্দর আলী,কমরেড আছদ্দর আলী,আছদ্দর আলী,তাজুল মোহাম্মদ,tajul mohammed,comrade asaddar ali,asaddar ali,comrade assador ali,assador ali

বৃটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের এক পর্যায়ে ভারত বর্ষে গড়ে ওঠে অনেকগুলো বিপ্লবী গ্র“প। তারা বৃটিশ বেনিয়াদের হত্যা করে ভারতের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন। বৃটিশ সরকার সে সব গ্র“পকে অভিহিত করেছিল সন্ত্রাসবাদি দল হিসেবে। কিন্তু উপ-মহাদেশের যুবক তরুণরা সেদিন সে পথেই দেশের মুক্তি খোঁজে। স্বাধীনতার স্বপ্নকে বুকে লালন করে যোগ দেয় তারা যুগান্তর, অনুশীলন, দীপালী প্রভৃতি সংগঠনে। সিলেট অঞ্চলেও এসব দল ও সংগঠন শক্তিশালী হয়ে উঠে এবং সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিল। তা করতে গিয়ে অনেকেই গলে পরেছেন ফাঁসির রজ্জু। জীবনের বিরাট অংশ কেউ কেউ কাটিয়েছেন দীপান্তরে কিংবা কারান্তরে। রাশিয়ায় তখন সংঘটিত হয়েছে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব। দেশে দেশে পড়েছে এর ইতিবাচক প্রভাব। আমাদের এ উপ-মহাদেশও বাদ পড়েনি। দ্বীপান্তরে এবং জেলে বসে বসে সেই সন্ত্রাসবাদীরা পড়েন মার্ক্সীয় সাহিত্য। তারপর বামপন্থি তথা সমাজতান্ত্রিক রাজনীতিতে উদ্বুদ্ধ হন তারা। জনগণের বিপ্লবী আন্দোলন গড়ে তুলতেই তারা জন্ম দেন ভারতীয় কমিউনিষ্ট পার্টির। সাথে সাথে তা বিস্তৃত হয় সিলেটে। এক ঝাঁক যুবক-তরুণ সমাজ বদলের স্বপ্নে বিভোর হয়ে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন সংগ্রামের সূচনা করেন। তারা ছিলেন দেশপ্রেমিক, ত্যাগী ও লড়াকু। দিনে দিনে বৃদ্ধি লাভ করে তাদের সংখ্যা। কিন্তুু ১৯৪৭ সালে তাদের গায়ে লাগে বিরাট ধাক্কা। সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে বিভক্ত হয় ভারত। আমাদের প্রিয় বঙ্গদেশও দ্বিখন্ডিত হয়ে দু’টি স্বাধীন দেশের অন্তর্ভূক্ত হয়ে গেল। পাকিস্তান নামক উদ্ভট রাষ্ট্রে ইসলামের নামে শুরু হল প্রগতিশীল কর্মীদের উপর নির্যাতন। রবিদাম সহ অনেক কমিউনিস্ট নেতাকে প্রাণ দিতে হয়েছে পাকি পুলিশ বাহিনীর গুলিতে। কারাগারে ধুঁকে ধুকে জীবনী শক্তি হারিয়েছেন অনেকে। সৃষ্টি হয়েছে শানেশ্বরের ন্যায় বধ্যভূমি। শুরু হয় বিপ্লবীদের দেশত্যাগ। হাজার হাজার কমিউনিস্ট বামপন্থিদের ভারতে যাবার ফলে সৃষ্টি হয় বিরাট শূণ্যতা। আর, সিলেট অঞ্চলে যে শূণ্যতা পূরণ করতে যারা এগিয়ে আসেন তাদেরই একজন ছিলেন কমরেড আসাদ্দর আলী
সিলেটের ওসমানীনগর (সাবেক বালাগঞ্জ থানা) থানার কাজিরগাঁওয়ে ছিল পৈত্রিক নিবাস। ১৯২৫ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর সে গ্রামেই তাঁর জন্ম। তাজপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ সমাপ্ত করে সবেমাত্র মঙ্গলচন্ডি নিশিকান্ত উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র। তাজপুরে আসেন কমরেড দিগেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত। বাড়ি দুলালী পরগনায়। কমিউনিস্ট পার্টি সিলেট জেলা কমিটি গঠিত হলে সেই প্রথম কমিটিতে সদস্য ছিলেন এই মার্ক্সবাদি পন্ডিত। এর আগে ছিলেন সন্ত্রাসবাদি আন্দোলনের সৈনিক। তরুণ সংঘ নামক একটি সন্ত্রাসবাদি গ্রুপের জন্যে কর্মী সংগ্রহ করতে জেলার একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত চষে বেড়িয়েছিলেন নিখিল ভারত ছাত্র ফেডারেশনের সাইনবোর্ড। বিদ্যালয়ের সকল ছাত্রদের নিয়ে একটি মিছিলও বের করিয়েছিলেন তিনি। তারপর একদিন উপস্থিত ঘটে ছাত্র ফেডারেশনের অপর এক নেতা দেবব্রত দত্তের। ডাক নাম রানু দত্ত (প্রবাদতুল্য কমিউনিস্ট নেতা বারীন্দ্র কুমার দত্তের ৬ষ্ঠ ভ্রাতা) আসাদ্দর আলীর সাথে কথা বললেন তিনি। বৈঠক হল দু’জনের মধ্যে। আসাদ্দর আলী হয়ে জান ছাত্র ফেডারেশনের সদস্য। সে থেকেই ধরে নেয়া যায় তার রাজনীতিতে হাতেখড়ি। অংশগ্রহণ করতে থাকেন বিভিন্ন কর্মসূচিতে। ১৯৪৫ সালে মেট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে চলে আসেন শহরে। ভর্তি হলেন মুরারিচাঁদ মহাবিদ্যালয়ে। খুবই দ্রুত প্রসারিত হলো তাঁর কর্মক্ষেত্র।
আসাদ্দর আলীর প্রাথমিক জীবনে আরো কিছু পরিচয় ছিল। শুরুতে একজন ফুটবলার হিসেবে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে নামডাক। সৃষ্টি হয়েছিল একটি বলয়। এ ধরনের একটি পরিচয় নিয়ে এগিয়ে যাবার কালেই শুরু হয় লেখালেখি। ভাল কবিতা লিখতেন। তার সাথে গানও। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনকালে গান লিখে নির্বাচনী জনসভায় পরিবেশন করাতেন আজহার আলীকে (মরহুম) দিয়ে। এরপরে আন্দোলন সংগ্রামের সময়েও তার গান পরিবেশিত হয়েছে। লিখেছেন অনেক গল্প। তবে জীবন ঘনিষ্ঠ। বাস্তবতার সাথে সম্পর্কিত, রাজনৈতিক দিক নির্দেশনামূলক প্রবন্ধ। অবশ্য তার লেখার সাথে খুব বেশি পাঠকের যোগাযোগ হয়নি। তিনি কখনো প্রেসে দিতে চাইতেন  না। এটা বলা যায় তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। কিন্তু আসাদ্দর আলীর ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা পড়তেন তার সাহিত্যকর্ম। তারা তাঁকে সম্বোধন করতেন কবি সাহেব বলে। আবার কেউ কেউ ডাকতেন ডাক্তার সাহেব। এ ব্যাপারে দু’রকম তথ্য পাওয়া যায়। যেমন আসাদ্দর আলী নামে সিলেটে একজন ডাক্তার ছিলেন বলে তাকেও ডাক্তার সাহেব বলে সম্বোধন করা হত। প্রফেসর আব্দুল আজিজ তাঁর ‘অন্তরঙ্গ আলোকে আসাদ্দর আলীম্ব নামক প্রবন্ধে (তারই গ্রন্থ স্মৃতি বিস্মৃতির প্রজন্ম), এ ধারনার উল্লেখ করেছেন। তবে, কারো মতে একটা সময়ে নিজ এলাকার লোকজনদের তিনি হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা দিতেন। তাই, এ রকম অভিধায় অভিধায়িত হয়েছেন। আত্মগোপন কালে সিলেটেও তিনি হোমিও প্রেক্টিস করতেন। এক পর্যায়ে পড়াশোনা অসমাপ্ত রেখেই চলে যান তিনি সরকারি চাকুরিতে। কিন্তু বন বিভাগের চাকুরি তাকে বনমুখি, ধনমুখি বা প্রতিষ্ঠামুখি করতে পারেনি। পারবেই বা কেমন করে? আসাদ্দর আলীর বিত্তের বেসাতি না থাকলেও চিত্তের প্রসারণ ঘটে গেছে অনেক দূর পর্যন্ত। কানায় কানায় পূর্ণ তিনি রাজনীতির শৌর্যে বীর্যে। না, প্রচলিত রাজনীতি নয়। মানবিকতায় সিক্ত, ধর্মীয় ও গোত্রীয় সাম্প্রদায়িকতার উর্দ্ধে শোষণ-বঞ্ছনাহীন একটি সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার রাজনীতি। সে রাজনীতির দর্শন নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন তিনি। মার্ক্স এঙ্গেলস আর লেলিন রচনাবলি অধ্যয়ন করতে থাকেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। দাস ক্যাপিটালের কঠিন সূত্রগুলো আয়ত্ব করেন অতি দ্রুত এবং এর ব্যাখ্যা দিতেন অতি সহজ ভাষায়। নিজের জন্যে একটি ভালে চাকুরি, ভাল রেজাল্ট করে প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদ দখল, অগাধ অর্থ, উপার্জন, কোনটি তার লক্ষ্য নয়। যুগ যুগান্তর ধরে বঞ্চিত শোষিত জনতাকে রাজনৈতিকভাবে প্রশিক্ষিত করে তাদের সাথে নিয়ে একটি বিপ্লব সাধন করা। শোষন ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থাকে পাল্টে সমতা ভিত্তিক, রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করাই ছিল লক্ষ্য।
পড়া-শোনা নিয়েই কথা হচ্ছিল একদিন। এরশাদের সামরিক শাসন তখন জগদ্দল পাথরের ন্যায় জেঁকে বসেছে। এর বিরুদ্ধে দেশব্যাপী চলছে চূড়ান্ত আন্দোলনের প্রস্তুতি। গঠিত হয়েছে জোট। ২২ দল, ১৫ দল, ৮ দল, ৭ দল। ১৯৮৪ সালে ১৬ই আগষ্ট বালাগঞ্জ থানা সদরে ১৫ দলের সভায় যোগ দিয়েছেন। যোগ দিয়েছিলেন আর এক কিংবদন্তি, ন্যাপ নেতা পীর হবিবুর রহমান (গণতন্ত্রী পার্টির সভাপতি (মরহুম)। আওয়ামীলীগ, বাকশাল, জাসদ সহ অন্যান্য দলের নেতারাও অংশ গ্রহণ করেন। আর, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবির) পক্ষ থেকে উপস্থিত ছিলাম আমি। সভা শেষে বেশ রাত করে ফিরছি সিলেট শহরে। বাসে আসাদ্দর আলীপীর হবিবুর রহমানের পাশে বসারও সুযোগ পেয়েছি। পড়াশোনা নিয়েই কথা হচ্ছিল। কি পড়ি, কোন বইয়ে কি সমস্যা ইত্যাদি। বলছিলাম একটি সমস্যার কথা। কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের মেনোফেস্টো বার বার পড়েও মর্মার্থ উদ্ধার করতে পারছি না। প্রশ্ন করলেন কতবার পড়েছি এবং মনোযোগ সহকারে পড়েছি কি না? তখন পর্যন্ত অন্ততঃ ১০ বার পড়েছি বলে জানবার পর আসাদ্দর আলী একটু হাসলেন। বললেন, ‘দেখ বাংলা এবং ইংরেজি মিলিয়ে শতবারের কম পড়িনি। তারপরও একথা বলতে পারছি না যে পুরোপুরি আয়ত্ব করতে সমর্থ হয়েছি। আর, তুমি তো মাত্র ১০ বার। খুব মনোযোগ সহকারে বার বার পড়। এক সময় দেখবে আয়ত্ব হয়ে যাবে। যতটুকু মনে পড়ে সেদিন সাম্যবাদি দলের জেলা নেতা আফরোজ আলীও সাথে ছিলেন। আলোচনায় শরিক ছিলেন তিনি। এভাবে পুরো পথই পড়া-শোনা নিয়ে, আন্দোলন সংগ্রামের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা চলে বাম রাজনীতির দুই দিক পালের সাথে। এর আগে ৩০ জুলাই তাজপুরে ছিল ১৫ দলীয় কর্মী সমাবেশ। সেখানেও উপস্থিত ছিলেন কমরেড আসাদ্দর আলী। উপস্থিত ছিলেন জাসদ সহ-সভাপতি আখতার আহমেদ (মরহুম) ও সাম্যবাদী দলের ধীরেন সিংহ। সিপিবির পক্ষ থেকে সেদিনও গিয়েছিলাম আমি। সাথে কমরেড আজহার আলী (মরহুম)। সেদিন আসাদ্দর আলীর সাথে স্থানীয় কিছু সমস্যা নিয়ে কথা হয় আমার। তাজপুর কলেজ নিয়ে সৃষ্ট দুঃখজনক ঘটনা, আসাদ্দর আলীর নিজের জমি-জমা নিয়ে বিরোধ সবকিছুর সাথেই জড়িয়ে আছেন আজহার আলী। আর, সে কারণে আমরাও পরোক্ষভাবে জড়িয়ে গেছি প্রতিটি বিষয়ের সঙ্গে। এ সব বিরোধের কারণগুলো বলতে বলতে কিছুটা হতাশাও বেরিয়ে আসে তার মুখ থেকে। এক সময় বললেন আমাকে- ‘‘জীবনে দু’টি ভুল আমি করেছি। প্রথমতঃ বৃদ্ধ বয়সে বিয়ে করেছি। আর দ্বিতীয়তঃ তাজপুরের মত জায়গায় একটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছি।” তিনি উদাসীনভাবে  বলে চললেন, ‘জানো তাজুল, আমার উচিত ছিল তাজপুরে কলেজ না করে একটি খোঁয়ার প্রতিষ্ঠা করা। আর, এ অঞ্চলে যারা একটু লেখাপড়া করেছে, তাদের সবাইকে ধরে ধরে এই খোঁয়াড়ে এনে বন্দি করে রাখা’।
স্বাধীনতার পরপরই আসাদ্দর আলীর উদ্যোগে তার নিজ এলাকায় এ কলেজটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এর জন্য জমি এবং অর্থ সংগ্রহ করতে গিয়ে আসাদ্দর আলী যে শ্রম এবং সময় দিয়েছেন তার তুলনা হয় না। দীর্র্ঘ সাধনার পর কলেজটি প্রতিষ্ঠিত হলেও স্বার্থান্বেষী মহল নানাভাবে তাকে এবং তার সহকর্মীদের হেনস্থা করার চেষ্টা করেছে। এমন কি সামরিক সরকারের সময়ে মিথ্যে মামলা দিয়ে হয়রানি করছে এই মহৎ লোকজনদের। এসব ঝামেলা মোকাবেলা করতে করতে কতটা ক্লান্ত হয়েছিলেন তা বুঝা যায় তার উপরোক্ত খেদোক্তি থেকে।
এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের নানা পর্যায়ে, নানাভাবে কমরেড আসাদ্দর আলীর কাছাকাছি যাবার সুযোগ হয়েছিল। কিছুটা হলেও তার কাছাকাছি যেতে সক্ষম হই। ছোট খাটো আব্দারও করেছি। খালি হাতে ফিরিনি কখনো। মনে পড়ে বালাগঞ্জ উদীচী আয়োজিত সুধি সমাবেশের কথা। ১৯৮৫ সালের মাঝামাঝি ইংল্যান্ডের ল্যাংগলেনে অনুষ্ঠিত আন্তর্জতিক লোক সঙ্গীত উৎসবে বালাগঞ্জ উদীচীর শিশু শিল্পীদল যোগ দিয়ে ৭ম স্থান অধিকার করেছিলো। ফিরে আসার পরে উদীচী সভাপতি আজহার আলীর বাড়ীতে (কলেজ বাড়ি) এ সমাবেশের আয়োজন। তারিখটা ছিল ৭ সেপ্টেম্বর। এতে সভাপতিত্ব করেন মঙ্গলচন্ডি নিশিকান্ত উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জৈন উল্লাহ (মরহুম)। অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন এম.সি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর আব্দুল আজিজ (শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ট্রেজারার), সিলেট মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর আবুল বশর, সাপ্তাহিক দেশবার্তা সম্পাদক শ্রী হিমাংশু শেখর ধর ঝনাবাবু (মরহুম), সিলেট প্রেসক্লাব সভাপতি বোরহান উদ্দিন খান এবং অবজারভারের সিলেট প্রতিনিধি সুধিরেন্দ্র বিজয় দাস প্রমুখ। আসাদ্দর আলীকেও দাওয়াত করেছিলাম সেদিন। কে কতটুকু গুরুত্ব পাবেন, কাকে প্রধান অতিথি বা বিশেষ অতিথি করা হচ্ছে তার কিছুই জানতে চাননি। মনে হয়েছে সে সব যেন কোন বিষয়ই নয় তার কাছে। হ্যাঁ, তিনি প্রথম থেকে শেষ অবধি উপস্থিত ছিলেন এবং বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্যও রাখেন।
১৯৮০ এর দশকের শেষ দিকে সিলেট অঞ্চলে সংঘটিত আন্দোলন-সংগ্রাম এবং এর পেছনের খ্যাতিমান মানুষগুলোকে নিয়ে কাজ করার একটি পরিকল্পনা নিই। যে কারণে রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এমন কি সামাজিক আন্দোলনের মহান ব্যক্তিদের কাছে শুরু হয় আমার দৌড় ঝাঁপ/তাদের স্মৃতি ধারণ। এ পর্যায়ে বাংলাদেশের সাম্যবাদী দলের সভাপতি আসাদ্দর আলীর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করি। উন্মোচিত হয় অনেকগুলো দ্বার। ছাত্র ফেডারেশন গড়ে তোলা, অসাম্প্রদায়িক ছাত্র সংগঠন ছাত্র ইউনিয়ন গঠনে আসাদ্দর আলীর গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকার সাথে পরিচয় ঘটে আমার। ১৯৪২ সালে নিখিল ভারত ছাত্র ফেডারেশনের মধ্য দিয়ে রাজনীতির জমিনে প্রবেশ। তার মাত্র ৫ বছর পরই শুরু হয় ভাষা বিতর্ক। বিভক্ত হয় ভারত ও বঙ্গদেশও। সিলেটে তখন বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দানের দাবিতে পালিত হয়েছে কর্মসূচি। ১৯৪৮ সালেই গড়ে উঠে দূর্বার আন্দোলন। আর সে আন্দোলনের একবারে সামনের সারি থেকে যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন তাদের মধ্যে আসাদ্দর আলী ছিলেন অন্যতম।
১৯৪৯ সালের ২০ ডিসেম্বর। বাগেরহাটে (তখনকার মহকুমা) এক পুলিশ কনস্টেবলকে হত্যা করার ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেশ জুড়ে শুরু হয় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। এ দাঙ্গা প্রতিরোধ কমিউনিস্ট পার্টি সর্বাত্মক প্রচেষ্টা গ্রহণ করে। তারপরও প্রাণহানি ঘটেছে সমগ্র দেশে। একমাত্র ব্যতিক্রম ছিল সিলেট। এর আগেই কমিউনিস্ট পার্টির পূর্ণাঙ্গ সদস্য পদ লাভ করেছেন পীর হবিবুর রহমান, তারা মিয়া এবং আসাদ্দর আলী। পার্টির নানা সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে তারা তখন সাহসী ভূমিকা পালন করেছেন। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হলে এর প্রতিরোধে পার্টির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ঝাঁপিয়ে পড়েন এ তিন নেতা। গঠন করেন তারা ‘মুসলিম লীগ শান্ত মিশন’। শহরের অলিতে গলিতে কাজ করেছেন নেতারা দিন রাত। গঠন করেছেন স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী। আসাদ্দর আলী মদমমোহন কলেজ থেকে ৩শ’ স্বেচ্ছাসেবক সংগ্রহ করেন ৫শ’ সদস্য। ছড়িয়ে পড়েন তারা শহরে ও গ্রামে । সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করার প্রয়াস যে বা যারা চালিয়েছে তাদেরই ধরে ধরে পুলিশের  হাতে সোপর্দ করা হয়। অবশেষে মানবীয় শক্তির হাতে পরাজয় ঘটে দানবীয়তার। এ নিয়ে অবশ্যি এর আগে অনেক দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছে। অবশেষে সিলেট সফরে আসেন পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ডাঃ আব্দুল মালেক। মুসলিম লীগ শান্তি মিশনের কাজ কর্মে সন্তুষ্ট হয়ে তিনি বলেন, ‘আপনারা সমস্ত পূর্ববঙ্গে দৃষ্টান্ত স্থাপন করিয়াছেন।’ তিনি শান্তি মিশনের প্রচার পত্র ইত্যাদি নিয়ে গিয়ে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক মন্ত্রিদের দেখান। এমন কি পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যাগুরু নেতাদেরও প্রদর্শন করেন। আর নওবেলালের ২৩ ফেব্রুয়ারী ১৯৫০ সংখ্যায় বলা হয়, ‘বিক্ষুব্ধ পূর্ব পাকিস্তানে সিলেটের শান্তি মিশন ইতিহাস সৃষ্টি করিয়াছে।’ এরপর থেকে প্রশাসন এবং শান্তি মিশন একই সাথে কাজ করেছে। থানায়-থানায়, হাটে-বাজারে, গ্রামে-গ্রামে, সভা-সমাবেশ হয়েছে। এতে প্রশাসন এবং শান্তি মিশনের নেতারা বক্তব্য রাখতেন। আর, আসাদ্দর আলীর স্বেচ্ছাসেবকরা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে শান্তিভঙ্গকারীদের প্রতিহত করেছেন।
সাম্প্রদায়িকতা প্রতিহত করার আন্দোলন করতে করতেই একটি অসাম্প্রদায়িক ছাত্র সংগঠন গড়ে তোলার ধারণা জন্মে। এ ধরনের সংগঠন গড়ে তোলার জন্যে আসাদ্দর আলীকে চেয়ারম্যান এবং তারা মিয়াকে আহবায়ক করে একটি প্রস্তুতি কমিটি গঠন করা হয়েছিল। সে কমিটি বিশেষ করে আসাদ্দর আলী তারা মিয়ার তৎপরতায় ১৯৫১ সালের ১৬ নভেম্বর জন্ম  নেয় সিলেট জেলায় জন্ম নেয় সিলেট জেলা ছাত্র ইউনিয়ন। এর আগে প্রশাসন এ সংগঠন যাতে আত্মপ্রকাশ করতে না পারে তার জন্যে সিলেট সদর থানা এবং পরে গোলাপগঞ্জ ও কুলাউড়া থানা এলাকায় ৩ মাসের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করে সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করে। একই সাথে আসাদ্দর আলী, তারা মিয়া এবং নাসির উদ্দিন আহমেদ চৌধুরীর বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত নিষেধাজ্ঞাও জারি হয়। তারা কোথাও সভা সমাবেশ যোগ দিতে পারবেন না। তা সত্ত্বেও পিছপা হননি আসাদ্দর আলীরা। সিলেট জেলা ছাত্র ইউনিয়ন বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের পূর্বসূরি।
কমিউনিস্ট পার্টি আত্মগোপনে থাকাকালে কমরেড আসাদ্দর আলী কাজ করেছেন আওয়ামী লীগে। সিলেট জেলা কার্যকরি কমিটির দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। ন্যাপ গঠিত হলে তিনি জেলা সম্পাদকের পদ গ্রহণ করেন। তারপর কেন্দ্রীয় কাউন্সিলর। ন্যাপেও এক সময় ভাঙ্গন আসে। আসাদ্দর আলী মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন অংশের প্রাদেশিক কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। এ সময় তিনি জাতীয় গণযুক্তি ইউনিয়ন (জাগমুই) নামে একটি দল গঠন কলে এর সহ-সভাপতির দায়িত্ব নেন। কারণ, সাম্যবাদী দল তখন আত্মগোপনে ছিল। ১৯৭৭ সালে দলটি প্রকাশ্য হলে তিনি সে দলের কেন্দ্রয় কমিটির সদস্য নির্বাচিতহন। ১৯৮৩ সালে নির্বাচিত হন দলটির সাধারণ সম্পাদক, ১৯৮৭ সালে সভাপতি এবং ১৯৮৯ সালে উপদেষ্টা মন্ডলীর সভাপতি। কালে তিনি আবির্ভূত হন বাংলাদেশের একজন শীর্ষ স্থানীয় মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিক হিসেবে। মার্ক্স এঙ্গেলেসের দর্শনের উপর ছিল অগাধ পান্ডিত্য। কমিউনিস্ট বিশ্বের অনৈক্য তাকে দারুনভাবে নাড়া দিত। কথাটা নানা ভাবে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ব্যক্ত করেছেন। কমিউনিস্টদের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা ছিল তার জীবনের এক প্রধান লক্ষ্য। এ লক্ষ্য বাস্তবায়নে কাজ করেছেন অবিরাম।
কমরেড আসাদ্দর আলী বাংলাদেশের একজন প্রথমসারির মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিক একথাটা আগেই উল্লেখ করেছি। সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক এবং পরে সভাপতি। সিলেটে সিপিবির হাল তখন আমাদের ন্যায় কিছু যুবকের হাতে। দু’পার্টির মধ্যে মধুর সম্পর্কতো নয়ই স্বাভাবিক সম্পর্কও বলা যায় ছিল না। কিন্তু আসাদ্দর আলী বাড়িতে গিয়েছি আমি বার বার। মার্ক্সবাদ নিয়ে কথা বলতেন। আন্দোলন সংগ্রামের কাহিনী বর্ণনা করতেন ঘন্টার পর ঘন্টা। রাজনীতির পাাশাপশি সাংবাদিকতা এবং লেখাজোকার সাথে জড়িত থাকায় আমাকে নিয়ে ছিল তার একটু বেশি আগ্রহ। যতবারই গিয়েছি ততবারই বলেছেন কমিউনিস্ট ঐক্যের পক্ষে লেখাখেখি করতে। বলতেন শুধু সিপিবি দিয়ে হবে না। অন্যান্যদেরও সাথে নিতে হবে। ছোট বড় যাই হোক কমিউনিস্টদের সকল গ্রুপ ও সংগঠনকে একত্রিত করতে হবে। তবেই হবে শক্তি সমাবেশ। এ নিয়ে সিপিবির সাবেক সাধারণ সম্পাদক বারীন্দ্র কুমার দত্তের (প্রয়াত) সাথেও তিনি কথা বলতেন। বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতেন পীর হবিবুর রহমানের সঙ্গে। তার নিজের পার্টি এবং সিপিবির ঐক্য যেমন চেয়েছেন তেমনি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও সকল দেশের সকল পার্টির মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ সৃষ্টির প্রয়াস ছিল লক্ষণীয়। এ নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাথে আলোচনায় মিলিত হয়েছেন এই কমরেড। সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর ঢাকাস্থ দূতাবাসের মাধ্যমে তার বক্তব্য প্রচার করতেন ঐ সব দেশে। তাদের মতামতও জানাতে পারতেন একই মাধ্যমে। বিশেষ করে চীন ও সোভিয়েত ইউনিয়নের পার্টিদ্বয়ের মধ্যেও সমঝোতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দুতিয়ালী করেছেন। গিয়েছেন চীন এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন। কমিউনিস্ট ঐক্যের ব্যাপারটি নিয়ে তিনি নিজেও অনেক প্রবন্ধ লিখেছেন। সাম্যবাদী দলের সাপ্তাহিক মুখপত্র ছিল ‘গণশক্তি’। এ পত্রিকার সম্পাদনাও করতেন তিনি।
১৯৮৯ সালের দিকে কমরেড আসাদ্দর আলী দূরারোগ্য ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। চিকিৎসা চলছিল ঢাকায়। কিছুদিন পর পর আসতেন সিলেট। সে সময় খুব বেশি দেখা সাক্ষাৎ হয়নি। একদিন গিয়েছিলাম তার সাক্ষাৎকার নিতে। কথা বলতে বলতে খাবার সময় হয়ে গেছে। টেবিলে ডাক পড়ল আমারও। কমরেড আসাদ্দর আলী, ভাবী এবং আমি। কিন্তু ভাত এবং তরকারি দু’জনের। তিন ভাগ করা হল খাবার। কিন্তু আসাদ্দর আলী সন্তুষ্ট হলেন না। বললেন, ‘আমাদের অসুবিধা হবে না। কিন্তু, তাজুল তুমি যুবক মানুষ। তোমার আরো বেশি খাবার প্রয়োজন।’ ভাবীকে বললেন পাউরুটি এবং দুধ এনে দিতে। আমার কোন কথাই শুনলেন না। বললেন, কয়েক টুকরো পাউরুটি দুধে মিশিয়ে খেয়ে নিতে। না, তিনি নিজেই পাউরুটি দুধে ভিজিয়ে এগিয়ে দিলেন আমার দিকে। মানবপ্রেমিক আসাদ্দর আলী, মানবতার জন্য কর্মরত প্রতিটি কর্মীকে এভাবেই স্নেহ করতেন।
পিজি হাসপাতালে আসাদ্দর আলী যখন চিকিৎসাধীন তখন প্রয়োজনে বিদেশে পাঠিয়ে তার সুচিকিৎসার দাবি জানানো হয়েছিল। এ দাবির পক্ষে আমরা কিছু স্বাক্ষরও সংগ্রহ করেছিলাম। ১৯৯০ সালে ২ জানুয়ারী পত্রিকায় প্রকাশিত হয় একটি সংবাদ। তাতে আসাদ্দর আলীর সুচিকিৎসার দাবি জানিয়ে যারা স্বাক্ষর করেন তাদের মধ্যে ছিলেন কবি দিলওয়ার, শিক্ষাবিদ অধ্যক্ষ কৃষ্ণ কুমার পাল চৌধুরী (প্রয়াত), অধ্যাপক বিজিত কুমার দে, আবু হেনা চৌধুরী, পৌর চেয়ারম্যান আ. ফ. ম কামাল, সাংবাদিক শ্রীহিমাংশু শেখর ধর ঝনাবাবু (প্রয়াত), মহিউদ্দিন শীরুআল আজাদ, রাজনীতিবিদ আব্দুল হামিদ, ফজলুর রহমান, লোকমান আহমেদ, আব্দুল মালেক, ধীরেন সিংহ, আব্দুর নূর মাষ্টার, তাজুল মোহাম্মদ, গুলজার আহমেদ, তাপস ভট্টাচার্য্য, এখলাছুর মোমিন, সুজাত আলী রফিক, আবুল হোসেন, বেদানন্দ ভট্টাচার্য্য, ও মা. আ. মশাহিদ। চিকিৎসক ডাঃ লুৎফুর রহমান চৌধুরী, ডাঃ আব্দুল হক চৌধুরী ও ডাঃ এম হাসান খান। কিন্তু সরকার বা কোন সংস্থা, সংগঠন এগিয়ে আসেনি আসাদ্দর আলীর চিকিৎসার সাহায্যর্থে। অবশেষে হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়া হয় তাকে সিলেটে। কাজীটুলার বাসায় মাঝে মধ্যে যাতায়াত করতাম তাকে দেখার তরে। প্রতিবারই বলতেন আমি যেন কমিউনিস্ট ঐক্যের পক্ষে লেখা চালিয়ে যাই। একদিনের কথা। ১৯৯০ সালের জানুয়ারীর শেষ সপ্তাহ। পার্টি অফিসে বসে কাজ করছি। আসলেন জেলা সম্পাদক কমরেড আব্দুল মালেক এডভোকেট (আওয়ামী লীগ নেতা)। কথা হচ্ছিল আসাদ্দর আলীকে নিয়েই। মালেক ভাইয়ের একটি প্রস্তাব নিয়েই আলোচনা শুরু হয়। ১৯৪৭ এর পরবর্তী সময়ে সিলেটে যারা তিলে তিলে গড়ে তুলেছেন কমিউনিস্ট পার্টি এবং বাম প্রগতিশীল আন্দোলন তাদের একজন প্রধান ব্যক্তিত্ব আসাদ্দর আলীসিপিবি হোক, সাম্যবাদী দল হোক মূলতঃ আসাদ্দর আলীদের হাতে গড়া পার্টি থেকেই বের হয়েছে এক একটি খন্ড। আমরা আমাদের জেলা কমিটির নেতারা এক সাথে উনার সঙ্গে দেখা করতে যাব। মৃত্যুর আগে অন্ততঃ দেখে যাবেন তার শ্রমে ঘামে গড়ে ওঠা কমিউনিস্ট পার্টির জেলা নেতারা তাকে শ্রদ্ধা জানাতে গেছে। মোটর সাইকেলে চড়ে সবাইকে ডেকে আনা হল অফিসে। তারপর সকলে মিলে চলে যাই তার বাড়িতে। আরো অনেকে ছিলেন সেদিন। আসাদ্দর আলীর কথা বলা নিষেধ। সমগ্র জিহ্বা গ্রাস করেছে মরণ ব্যাধি ক্যান্সার। তাই কথা বলা বারণ। আমাদের সাথে ভাব বিনিময় করছেন ইশারায়। বার বার মুষ্টিবদ্ধ ডান হাত উপরে তুলে এবং পরক্ষণে তিন আঙ্গুল একত্র করে বুঝাতে চাইছেন আমি যেন কমিউনিস্ট ঐক্যের পক্ষে লেখি। সে এক অসহ্য যাতনা। নিজে বুঝতে পারছেন জীবন তরী তীরে ভিড়ছে। যে কোন মুহূর্তে নিভে যাবে প্রদীপ। তবু ভাবছেন না নিজের কথা। একটি সুখি সুন্দর সমাজ ব্যবস্থার স্বপ্ন তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। সমাজতন্ত্র, কমিউনিস্ট পার্টি এবং কমিউনিস্ট ব্যতীত কিছু নেই তার ভাবনায়, তার চেতনায়। একটু পরে আসেন গণতন্ত্রী পার্টির নেতা আব্দুল হামিদ। সাথে সাথেই চিৎকার করে উঠে বসে যান বিছানায়। বলেন, ‘এত পরে এলে তুমি? আমিতো বেঁচে আছি শুধু তোমার জন্য। এই সিলেট অঞ্চলের যারা কমিউনিস্ট আন্দোলনে শরিক হয়েছিল, যারা আমাদের কাঁধে কাধ মিলিয়েছিল, তাদেরকে আমি কোথায় রেখে যাব? কমিউনিস্ট আর বামপন্থিদের জন্য সিলেটে তুমি এক বটবৃক্ষ। তোমাকেই ওদের ছায়া দিয়ে রাখতে হবে। বটবৃক্ষের ছায়াতলে ওদেরকে আমি রেখে যেতে চাই। নিশ্চিত মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে এমনভাবে নিজের আদর্শের সৈনিকদের প্রতি ভালোবাসার প্রকাশ কেউ কোন কালে ঘটিয়েছেন কি না আমার জানা নেই।
১৯৯০ সালে ২ ফেব্রুয়ারী কমরেড আসাদ্দর আলী ইহলোক ত্যাগ করেন। সিলেটে আসাদ্দর আলীর নাগরিক শোক সভা অনুষ্ঠিত হয়। এ উপলক্ষে আমরা একটি বুকলেট প্রকাশ করেছিলাম। সম্পাদনা করেন রফিকুর রহমান লজু। সে বুকলেটে আমি উল্লেখ করেছিলাম আসাদ্দর আলী মস্কো সফর করেছেন। কিন্তু মেনে নেননি সাম্যবাদী দলের সম্পাদক দিলীপ বড়–য়া। আসাদ্দর আলীর মস্কো সফরকে একটি অলিক ঘটনা হিসেবে আখ্যায়িত করে এর প্রতিবাদ করেন। লজু ভাইও চটে যান আমার উপর। সত্যাসত্য যাচাই না করে কেন তা গ্রন্থে সন্নিবেশিত করেছি প্রশ্ন তার। পুরো ঘটনাটা যখন ঘটেছে তখন সেখানে বিভিন্ন দলের কেন্দ্রীয় নেতারা উপস্থিত ছিলেন। লজু ভাই ব্যাপারটি নিয়ে কথা বলেন, জননেতা পীর হবিবুর রহমানের সাথে। পীর সাহেব বলেন, ‘তাজুলতো না জেনে লেখেনি। কিন্তু তার দলীয় নেতারা যে অস্বীকার করছেন। হ্যাঁ, আমি শুনেছি সরাসরি আসাদ্দর আলীর নিকট থেকে। তার নিকট থেকেতো সত্যতা যাচাই করার কোনো সুযোগ আর নেই। অন্য একজনও আমাকে বলেছেন। যার সাথে তাৎক্ষণিক যোগাযোগ করার সুযোগ নেই। পীর হবিবুর রহমান বললেন, ‘আসাদ্দর আলী লন্ডন গিয়েছিলেন, এইটুকু জানতেন দলীয় নেতারা। কিন্তু সেখান থেকে মস্কো যাবার ব্যাপারটা একমাত্র তাদের দলীয় প্রধান কমরেড মোহাম্মদ তোয়াহা এবং সিপিবির আব্দুস সালাম (বারীন্দ্র কুমার দত্ত) জানতেন। দিলীপ বড়–য়ারা এ সবের কিছুই জানতেন না।’ তখনকার মত মীমাংসা হয় ব্যাপারটি।
কমরেড আসাদ্দর আলী তত্ত্বীয় এবং প্রয়োগীয় ক্ষেত্রে মার্ক্সীয় দর্শনে ছিলেন সমভাব পারদর্শী। মার্ক্সবাদকে নিজে আত্মস্থ করে পার্টি এবং নিজের জীবনে এর প্রয়োগ ঘটাতে সার্বক্ষণিক প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। একই সাথে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালেও অবদান রাখার প্রচেষ্টা ছিল তার।  দেশে এবং বিশ্বে কমিউনিস্টদের মধ্যে ঐক্য স্থাপন করাই ছিল তার লক্ষ্য। সে লক্ষ্য বাস্তবায়নের জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। তার জীবনে ছিল একজন প্রকৃত মার্ক্সবাদীর প্রতিফলন।

তাজুল মোহাম্মদ: প্রবাসী লেখক।

Post a Comment

কমরেড আসাদ্দর আলী বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় নাম।তিনি সারাজীবন মেহনতী মানুষের কল্যানে কাজ করে গেছেন।১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে তার অবিস্মরণীয় অবদান ছিল।তিনি কমিনিষ্ট আন্দোলনের পথিকৃত এবং বাংলাদেশের সাম্যবাদী দলের সাবেক সভাপতি ছিলেন।গণ মানুষের নেতা কমরেড আসাদ্দর আলীর স্বরনে একটি ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা মাত্র।সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ।