পাকিস্তানে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের পূর্ব পর্যন্ত কমিউনিস্ট পার্টি সরকারীভাবে বেআইনী ছিল না। কিন্তু ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত কমিউনিস্ট পার্টি প্রকাশ্যও ছিল না। ১৯৫৩ সালে কমরেড তারা মিয়ার নেতৃত্বে সিলেটে কিছু সংখ্যক কমিউনিস্ট কর্মী প্রকাশ্যে কাজ করতে আরম্ভ করার সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি নতুন ধারার সৃষ্টি হয়। আমরা অন্যান্য কমিউনিস্টরা আওয়ামীলীগ ও গণতন্ত্রী দলের ভিতর পূর্বের মতই কাজ করতে থাকি। এ কৌশল বৃটিশ আমলেও ছিল। তখন কমিউনিস্টরা “কংগ্রেস” ও “মুসলিম লীগের” ভিতর ও বেনামীতে কাজ করতেন। আমরা তখন ছাত্র ফেডারেশনের কর্মী। কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে আমরাও বৃটিশ বিরোধী বৃহত্তম জাতীয় ঐক্য গঠন করার জন্য “কংগ্রেস লীগ এক হও” শ্লোগান দিয়েছি। এক এক সময় বিরাট ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের ধাক্কায় বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদী আইন কানুনের দেওয়াল গুলি ধ্বসে পড়ত। মনে হত, মুক্তির সিংহদ্বার বুঝি খুলে গেল।
তারপর এল ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতা। কিন্তু এ কি চেহারা স্বাধীনতার? কংগ্রেস খন্ডিত ভারতের এবং মুসলীম লীগ বিকলাঙ্গ পাকিস্তান শাসন ক্ষমতায় বসে দুর্দ্দন্ড প্রতাপে দেশবাসীর মাথার উপর এক হাতে শাসন দন্ড ঘুরাতে আর অন্যহাতে বৃটিশ কমনওয়েলথে থেকে যাওয়ার চুক্তি স্বাক্ষর করে সাম্রাজ্যবাদীদের সঙ্গে আপোষ করল। শ্রমিক কৃষক মধ্যবিত্ত জনতা যে তিমিরে ছিলেন সে তিমিরেই থেকে গেলেন। কমিউনিস্ট পার্টি দেখল কোথায় ভুল হয়ে গেছে। ঐক্যবদ্ধ বিরাট বিরাট আন্দোলনের ফসল বড় বড় রাজনৈতিক দল কংগ্রেস ও মুসলীম লীগের গোলায় উঠেছে। কমিউনিস্টরা ত্যাগ তিতিক্ষা ও সততার পুজি নিয়ে বঞ্চনার বালুচরে পড়ে রয়েছেন। তাঁহারা আওয়াজ তুললেন, ‘এ আজাদী ঝুটা হায়।’ ডাক দিলেন, সশস্ত্র বিপ্লবের। ভাংগা গড়ায় আজিমুশ্বান খেলার পর জন সাধারণ তখন নিরপেক্ষ ও হতভম্ব। সদ্য-স্বাধীন, ক্ষমতার মদে মত্ত সামন্ত আমলা মুৎসুদ্দি শ্রেণীর শাসকরা নেকড়ে বাঘের মত হিংস্র থাবা নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ল কমিউনিস্টদের উপর। বহু কমরেডকে হত্যা করা হল। অসংখ্য কমরেডকে জেলে বন্দী করা হল। গুলি ও জেলের হাত থেকে যারা বাঁচতে পারলেন তাঁরা আত্মগোপন করে অবর্ণনীয় দুঃখ-দদুর্দশা ভোগ করে ও বিপদের ঝুঁকি মাথায় নিয়ে কাজ করে চললেন। ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনকে উপলক্ষ করে পার্টি আবার আন্দোলনের উদ্যোগ গ্রহণ করে। সিলেটের ‘গোবিন্দ চরণ পার্কে’ বাংলাভাষার দাবীতে একটি জনসভার আয়োজন করা হয়। সরকারী দলের লোকরা মিটিং ভেঙ্গে ফেলে। কিন্তু এ মিটিং ও ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে কমিউনিস্ট এবং অন্যান্য প্রগতিশীল কর্মীরা আবার আন্দোলনে নামেন। ১৯৫১ সালের দিকে কমিউনিস্ট পার্টি ছাত্র যুবক ও জন সাধারণকে সংগঠিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করে। অকমিউনিস্ট বামপন্থি ও প্রগতিশীল ছাত্র যুবকদের পক্ষ থেকে ভাল উৎসাহ ও সহযোগিতা পাওয়া যায়। পার্টি সম্পাদক কমরেড রোহিনী দাশ (তাহের ভাই) এবং সাবেক ছাত্র ফেডারেশনের জনৈক নেতা (যাকে আমরা দিষু/দিপু ভাই বলে ডাকতাম) আমাদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতেন। দিষু/দিপু ভাই একদিন রায়নগরের মরহুম আবদুর রহীম (লালবারী মিয়া) সাহেবের বাড়ীতে তারা মিয়ার সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেন। প্রথম আলাপেই মনে হয় সত্যিই একজন নতুন মানুষকে পেলাম। কথাবার্তা স্পষ্ট, বক্তব্য স্বচ্ছ, বর্ণনাভংগী বস্তু নিরপেক্ষ। বন্ধুত্ব হয়ে গেল। পার্টি অন্যান্যদের সঙ্গে তারা মিয়া এবং আমাকেও নতুন একটি অসাম্প্রদায়িক ছাত্র সংগঠন গড়ে তোলার কাজ করতে উৎসাহ দেয়। একটি ভালো কাজ পাওয়া গেল। কোমর বেঁধে কাজে লেগে যাওয়া গেল।
একদিনের কথা আজো স্পষ্ট মনে আছে। ছাত্র সম্মেলনের সাংগঠিক সফরে দুইজন বেরিয়ে পড়েছি। প্রথম কুলাউড়া হয়ে অন্যত্র যাওয়ার কথা। ট্রেনে উঠে বসে দেখা যায় দুই জনের পকেটই শূন্য। গাড়ী ছাড়ার সময় হয়ে গেছে। এমন সংকট সময়ে তারা মিয়া গম্ভীর ভাবে মন্তব্য করল, “কুছ পরওয়া নেই। টাকা না থাকায় বরং লাভই হল।” রেল ভ্রমণের সময় পকেটে টাকা না থাকায় কি ভাবে ভাল হয় তা বুঝে উঠার আগেই নতুন পরিকল্পনা নিয়ে হাজির করল তারা মিয়া। বল্ল, আমরা ফেঞ্চুগঞ্জে নেমে পায়ে হেটে রাজনগর যাব। পথে যত স্কুল পাব তার সবগুলিতে কাজ করে যাব। তাই হল। কাজ করে করে রাত প্রায় ১০টায় রাজনগরের খাসপ্রেমনগরে তারা মিয়ার বাড়ীতে পৌছা গেল। এরপর অনেক বারই এই রকম ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু সরকার এও সহ্য করতে পারল না। কেন্দ্রীয় সরাষ্ট্র মন্ত্রী গিয়াস উদ্দিন পাঠান নিজে সিলেটে এসে নতুন ছাত্র সংগঠনের জন্ম নিরোধের কড়া নির্দেশ দিয়ে গেলেন। সম্মেলনের কিছুদিন পূর্বে তারা মিয়া এবং আমার উপর ১৪৪ ধারায় নির্দেশ জারী করা হল, -আমরা কোন সভা সমিতির সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে পারবো না। নেতাদের সাথে পরামর্শ করতে গেলে তাঁরা বল্লেন, ‘আত্মগোপন কর, না হয় ধরা পড়বে।’ তারা মিয়া একথা শুনে ভারী খুশি। বল্ল- ‘সরকার আমাদের কদর বুঝেছে।’ মরহুম ধলাবারী সাহেবের একটি নির্মাণাধীন বাড়ীতে আমরা আত্মগোপন করলাম। জীবনের প্রথম আত্মগোপন করলাম। বেশ রোমাঞ্চকর লাগছে। আরো জ্জ জন জননেতা এলেন। কাজ কর্মে কিছু পরিকল্পনা করতে হবে। কেহ কেহ চিন্তিত, এখন কি হবে? তারা মিয়ার স্পষ্ট কথা- আমাদের সম্মেলন সফল হইবে। এরপর আমাদের আলোচনারত রেখেই মানুষটি দিব্যি নাক ডাকিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। যে কোন প্রতিকূল অবস্থার জন্য তারা মিয়া সব সময়ই প্রস্তুত হয়ে থাকত। প্রায়ই বলত, ‘জনগণবিপ্লব, সমাজতন্ত্র, জেল, ফাঁসি প্রভৃতি এক সঙ্গে গলাগলি করে থাকে।’ ছাত্র সম্মেলন শত বাধা সাত্বেও সফল হয়েছিল। জন্ম নিয়েছিল জেলা ভিত্তিক সর্বপ্রথম অসাম্প্রদায়িক ছাত্র সংগঠন, ছাত্র ইউনিয়নের।
তারা মিয়া প্রায়ই আমার একটি দোষ ধরে দিত। বলত, - “তুমি এত বেশী বুঝাও যে ছাত্ররা তোমাকে মাষ্টার মনে করে ভয় পেয়ে যায়। দেখনা আমি কিভাবে ভাই ভাই হয়ে যাই।” তারা মিয়া সত্যিই দু’চার কথায় মানুষকে আপন করে নিতে পারত। কেবল ছাত্র ইউনিয়ন নয়-কমিউনিস্ট পার্টি, যুবলীগ আওয়ামী লীগ প্রভৃতি গঠনের কাজে তারা মিয়ার অবদান সুস্পষ্ট। তখনকার শ্রমিকনেতা মতছির আলী সাহেব প্রায়ই বাহির থেকে নতুন নতুন শ্লোগান আমদানী করে আমাদের উপহার দিতেন। আওয়ামীলীগ গঠন করার করার ব্যাপারে মৌলানা ভাসানীর সিলেট আগমন উপলক্ষে মতছির আলী সাহেব নতুন শ্লোগান আমদানী করেন- “ভাসানী কা পরনে কৌমকো জিন্দা কর দিয়া।” আওয়ামী লীগ সংগঠনের কাজে তারা মিয়া এই শ্লোগানটিকে ষোল আনার উপরে কাজে লাগান। ভাষা আন্দোলন, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির আন্দোলন এবং ১৯৫৪ সালের ইলেকশনে তারা মিয়ার ভূমিকা অবিষ্মরণীয়। কমিউনিস্ট এবং প্রগতিশীল কর্মীরাই সিলেটে যুক্তফ্রন্টের ভিত্তি রচনা করেন। পরে শোনা যায় দুইটি বড় বড় সংগঠন শর্ত দিয়াছে- কমিউনিস্টরা যুক্তফ্রন্টে না থাকলে তারা যুক্তফ্রন্টে যোগ দিবে। এতে মুসলীম লীগকে পরাজিত করা সহজ হবে মনে করে আমাদের কেহ কেহও এর পক্ষে মত দিতে থাকেন। তারা মিয়া এবং আমি বিরোধী ছিলাম। তারা মিয়া বলছিল, -“এ হবে নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা পরের যাত্রা ভঙ্গ করার সামিল।” কিন্তু পরে কেন্দ্রীয় কমিটি যখন সিদ্ধান্তই করল যে, কমিউনিস্টরা স্বেচ্ছায় যুক্তফ্রন্ট থেকে দূরে থাকবেন তখন পার্টির সিদ্ধান্ত মেনে নিতে তারা মিয়াকে একটুও বেগ পেতে হয়নি। কমিউনিস্টদের পক্ষে আওয়ামী মুসলীম লীগের ভিতর কাজ করা এবং আওয়ামী লীগকে গড়ে তোলার কৌশলকে তারা মিয়া এবং ভ্রান্ত বলে মনে করতাম। আমরা পার্টি গড়ে তোলা এবং শ্রেণী সংগঠন ও শ্রেণী সংগ্রামের নীতিতে বিশ্বাস করতাম। তখনকার জেলা কমিটির সদস্য কমরেড দিনেশ চৌধরী আমাদের মত সমর্থন করতেন।
তারা মিয়া কাজে কর্মে, আচারে-ব্যবহারে, চিন্তা-চেতনায় ও নীতি-কৌশলের দিক থেকে একজন বিপ্লবী ছিলেন। পার্টি ভাগ হয়ে যাওয়ার পর আমাদের মধ্যে মতভেদ সৃষ্টি হওয়া সত্ত্বেও আমাদের বন্ধুত্বের সম্পর্ক বজায় ছিল। মৃত্যুর কিছুদিন পূর্বে তারা মিয়া এবং আমার মতভেদের পরিসর ছোট হয়ে আসতে থাকে। কোন কোন বিষয়ে আমরা একমতই ছিলাম। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রতি সমর্থন দেওয়া বা বিরোধীতা করার ব্যপারে আমাদের মতানৈক্য খুব কম ছিল। আসলে তারা মিয়া ছিলেন জনগণের একজন খাঁটি দরদী মানুষ। জনগণের দুঃখ বেদনা ও মেজাজ মর্জি তার হৃদয়ের আয়নায় স্বাভাবিক ভাবেই প্রতিফলিত হত।
মৃত্যুর কিছুদিন পূর্ব থেকেই শারীরিক ও আর্থিক দিক দিয়ে তার অবস্থা ভাল ছিল না। কিন্তু তার অন্তরটি সব সময়ই জনগণের জন্য কাজ করার উদ্দাম আগ্রহে অধীর ছিল।
রফিকুর রহমান লজু সম্পাদিত ‘মনের মণিকোঠায়’ (১৯৮৪) থেকে
Post a Comment
0 comments
কমরেড আসাদ্দর আলী বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় নাম।তিনি সারাজীবন মেহনতী মানুষের কল্যানে কাজ করে গেছেন।১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে তার অবিস্মরণীয় অবদান ছিল।তিনি কমিনিষ্ট আন্দোলনের পথিকৃত এবং বাংলাদেশের সাম্যবাদী দলের সাবেক সভাপতি ছিলেন।গণ মানুষের নেতা কমরেড আসাদ্দর আলীর স্বরনে একটি ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা মাত্র।সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ।
Click to see the code!
To insert emoticon you must added at least one space before the code.