গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকের গোড়ার দিকে আমি তাজপুর মঙ্গলচন্ডী (অধুনা নিশিকান্ত যুক্ত) হাইস্কুলের ছাত্র ছিলাম। থাকতাম স্কুল থেকে মাইল দেড়েক উত্তরে খালার বাড়ীতে। প্রতিদিন হেঁটে স্কুলে যেতাম। স্কুলে পৌঁছবার একটু আগে বর্তমানে যেখানটায় তাজপুর-বালাগঞ্জ সড়ক সিলেট-ঢাকা মহাসড়কের সাথে যুক্ত হয়েছে সেখানে একটি কদমগাছ ছিল। এজন্য জায়গাটি কদমতলি নামে পরিচিতি লাভ করে। কদমতলিতে একটি চায়ের স্টল ছিল বারান্দায় বেঞ্চি পাতা থাকতো। পথচারী ও আরো দু’ একজন সেখানে বসে চা পানের সাথে একটু জিরিয়ে নিত। স্কুলে যাওয়া আসার পথে প্রায়ই সে চা স্টলের বেঞ্চে একজন সুবেশধারী যুবককে দেখতে পেতাম। পোষাক-পরিচ্ছদে যেমন ধোরদুরুস্ত তেমনি গৌরকান্তি স্বাস্থ্যোজ্জল চেহারা। মাথা ভর্তি চুল, চোখে স্বপ্নিল আবেশ। কেমন যেন কবি কবি সাব। সবাই তাকে কবি সাহেব বলে ডাকতো। কেউ বা ডাকতো ডাক্তার সাহেব। নাম জানা গেল আসাদ্দর আলী। তিনি আই সি এস অফিসার গজনফর আলীর বড় ভাই এবং পার্টনার ভূতপূর্ব সিভিল সার্জন। নামের মিলের কারণে পাড়া পড়শীরা
আসাদ্দর আলীকে ডাক্তার সাহেব বলে সম্বোধন করতো। এছাড়া তিনি কবিতা লিখতেন একথা অনেকের জানা ছিল বলে তাদের নিকট তিনি ছিলেন কবি সাহেব। আসাদ্দর আলী যে সময় বন বিভাগে চাকুরী করতেন ছুটি ছাটায় বাড়ি আসলে আড্ডা দিতে আসতেন কদমতলির চা স্টলে। তাঁর বাড়ি ছিল পাশের গ্রাম কাজিরগাঁও।
স্কুল থেকে ফেরার পথে একদিন আসাদ্দর আলী আমাকে ডেকে নিলেন। তিনি যথারীতি বসে ছিলেন চা স্টলে। আমাকে ডেকে, তিিিন জানালেন যে আমার খোঁজ খবর তিনি রাখেন। আমি সেবার বার্ষিক মিলাদ উপলক্ষে প্রবন্ধ প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছি সে খবরও তিনি পেয়েছেন। তিনি আমাকে পরদিন তাঁর বাড়িতে দেখা করতে বললেন। তখন বার্ষিক মিলাদ উপলক্ষে প্রবন্ধ প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছি সে খবরও তিনি পেয়েছেন। তিনি আমাকে পরদিন তাঁর বাড়িতে দেখা করতে বললেন। তখন বার্ষিক পরীক্ষা হয়ে গেছে। তাই সকাল সকাল স্কুল ছুটি হয়ে যেত। পরদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে গেলাম তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করতে। তিনি আমার নিকট জানতে চাইলেন আমি বইপত্র পড়াশোনা করি কিনা এবং এ যাবত কী কী বই পড়েই। আমি বললাম যে মজতবা আলীর দেশে বিদেশে, যাযাবর এর দৃষ্টিপাত এবং রঞ্জন এর শীতে উপেক্ষিতা পড়েছি। এছাড়া পত্রপত্রিকার মধ্যে অগ্যতা ও অচলপত্রের অনেকগুলি সংখ্যা পড়েছি। আমি সাপ্তাহিক সৈনিকের নিয়মিত পাঠক। শুনে কোনো মন্তব্য না করে জিজ্ঞাসা করলেন শরৎচন্দ্রের পথের দাবী পড়েছি কি না। যদি না পড়ে থাকি তবে তা পড়ে দেখতে পারি। এছাড়া তিনি আমাকে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় প্রভৃতি লেখকের লেখা পড়ারও পরামর্শ দিলেন। তদুপরি তিনি আমাকে সুভাস মুখোপাধ্যায়ের কবিতার বই ‘অগ্নিকোন’ এবং অরণি নামে একটি বই দিলেন (বই এর নাম অরণি না গ্রন্থকারের ছদ্মনাম এখন তা মনে করতে পারছিনা। সম্ভবত বইটি তখন নিষিদ্ধ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত ছিল)। এ দু’খানা বইয়ের মাধ্যমে আমার কাছে এক নতুন জগৎ উন্মোচিত হল। আমি এ ধরনের আরো বই পড়ার লোভে ঘন ঘন আসাদ্দর আলীর সাথে সাক্ষাৎ করতে লাগলাম। তিনি কথায় কথায় জানালেন যে বন বিভাগের চাকুরী ছেড়ে দিয়ে তিনি অচিরেই ভর্তি হতে চলেছেন। মদনমোহন কলেজের বিএ. ক্লাসে।
আসাদ্দর আলীর সাথে যোগাযোগের আরেকটি হেতু ছিল। আমি ছিলাম নবম শ্রেণীর ছাত্র। আমাদের বাংলা সিলেকশনে অন্তর্ভুক্ত কবিতাগুলো ভালভাবে বুঝিয়ে দেবার মত শিক্ষক স্কুলে ছিলেন না। আসাদ্দর আলী কবিতা লিখতেন, গল্প লিখতেন। তিনি সেগুলো আমাকে পড়ে শোনাতেন। এক কথায় তিনি ছিলেন একজন প্রতিশ্রুতিশীল সাহিত্যিক। সেই সুবাদে আমি তাঁর কাছে কবিতা বুঝতে যেতাম। এখনও মনে পড়ে তিনি আমাকে বেনজির আহমদের ‘আমার সাগরে জেগেছে ঊর্মি’ কবিতাটি ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। তখনও আমি ভালভাবে জানতাম না যে তিনি বামপন্থি রাজনীতির সাথে জড়িত।
আসাদ্দর আলীর সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল খাশি-খাপনের আব্দুল বারীর। বারী সাহেব ছিলেন একজন নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমিক। তিনি আমাকে খুবই ¯েœহ করতেন। তিনিই আসাদ্দর আলীকে আমার কথা বলে থাকবেন। তাজপুর ছিল জনাব বারীর কর্মস্থল। তিনি ছিলেন স্থানীয় মুসলিম লীগের নেতা, স্কুল পরিচালনা পরিষদের প্রভাবশালী সদস্য। তাজপুরস্থ বিভিন্ন অফিস-আদালতের কর্মকর্তাদের সাথে তাঁর ছিল হৃদ্যতার সম্পর্ক। তিনি আমাকে নিয়ে অনেক কর্মকর্তার বাসায় বেড়াতে যেতেন। আবগারি বিভাগের দুই কর্মকর্তা ছিলেন খুবই সাহিত্যরসিক। তাঁদেও সাথে পরিচয় হলে আমার নতুন নতুন পত্র-পত্রিকা পড়ার একটি উৎস খুলে যায়। অনেকদিন বারী সাহেব ও আমি একই সাথে আসাদ্দর আলীর বাড়িতে হাজির হতাম। কথাবার্তায় দেশের রাজনীতি উঠে আসতো। আসাদ্দর আলীর মাধ্যমেই আমি জানতে পারি মাওলানা ভাসানী দেশে আওয়ামী মুসলিম লীগ নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেছেন এবং মুলিম লীগের অপশাসন থেকে দেশকে মুক্ত করার চেষ্টা করছেন। আসাদ্দর আলীর প্রভাবে আব্দুল বারীর রাজনৈতিক মতাদর্শেও পরিবর্তন ঘটে।
১৯৫১ সালের কথা। মাওলানা ভাসানী সাংগঠনিক সফরে সিলেট আসলেন। আসাদ্দর আলী তাজপুওে একটি জনসভা আয়োজনের দায়িত্ব দিলেন আব্দুল বারীর ওপর। বারী সাহেব আমাদেও অর্থাৎ ছাত্রদের লাগিয়ে দিলেন পার্শ্ববর্তী বাজারগুলোতে গিয়ে জনসভার প্রচার চালাতে। তখন আজকের মত মাইকের ব্যবস্থা ছিল না। আমরা টিনের চোঙ্গা মুখে লাগিয়ে মাইকের কাজ চালাতাম। মনে পড়ে সেই টিনের মাইক দিয়ে গোয়ালাবাজার গিয়ে জনসভার প্রচার চালিয়েছিলাম। জনসভার তারিখ আজ আর মনে নেই। তবে এটুকু মনে আছে যে সময়টা ছিল শীতকাল। সকাল ১০ টার দিকে সভা আয়োজন করা হয়েছিল তাজপুর বাজারের উত্তর পাশের খোলা মাঠে। সেকালের মানদন্ডে জনসভায় যথেষ্ট লোক সমাগম হয়েছিল। সেদিনের সভায় মাওলানা ভাসানীকে প্রথম দেখলাম। মাওলানা দীর্ঘ সময় নিয়ে বক্তৃতা করলেন। অনলবর্ষী বক্তা। এক পর্যায়ে দেশের জিনিসপত্রের দাম উল্লেখ কওে জনগণের দুর্দশার বর্ণনা দিলেন। মাওলানার উপস্থিতিতে সে বছরই সিলেটে আওয়ামী মুসলিম লীগের জেলা কমিটি গঠিত হয়েছিল অধ্যাপক আব্দুল মালিককে সভাপতি ও ধলা বারীকে সম্পাদক নির্বাচিত করে। কিন্তু এ কমিটি তেমন সক্রিয় হতে পারেনি। পরের বছর আবার মাওলানা আসলেন এবং নূরুর রহমানকে সভাপতি ও ধলাবারীকে সম্পাদক করে কমিটি পুনর্গঠিত হল। এবারকার কমিটি গঠনের সাথে সিলেটে আওয়ামী মুসলিম লীগের জয়যাত্রা শুরু হয়।
১৯৫১ সালের শেষার্ধে সিলেটে একটি অসাম্প্রদায়িক ছাত্র সংগঠন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। তৎকালীন নওবেলাল পত্রিকার সহকারী সম্পাদক এ.এইচ সাদত খানের স্মৃতিচারণা অনুযায়ী অক্টোবর মাসে আসাদ্দর আলীকে অভ্যর্থনা কমিটির সম্পাদক করে নভেম্বর মাসের ১৬/১৭ তারিখে একটি ছাত্র সম্মেলন আহবান করা হয়। আসাদ্দর আলী তাজপুরে এসে আমাদেও সে সম্মেলনে যোগ দেবার জন্য উদ্বুদ্ধ করলেন। মঙ্গলচন্ডী হাইস্কুল থেকে আমি ও আরো ৩ জন এবং দয়ামীর মধ্য ইংরেজি স্কুল ও মাদ্রাসা থেকে ১ জন ছাত্র এ সম্মেলনে প্রতিনিধি হিসেবে যোগ দিয়েছিলাম।
যেহেতু ছাত্র সম্মেলনের উদ্দেশ্য ছিল একটি অসাম্প্রদায়িক ছাত্র সংগঠন গড়ে তোলা- শাসক গোষ্ঠি এর পেছনে কমিউনিস্টদেও হাত আছে বলে ধরে নিয়ে দমন নীতির আশ্রয় নিলেন। সিলেটে দুই মাসের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করা হল। এছাড়া সম্মেলনের উদ্যোক্তা হিসেবে
আসাদ্দর আলী, তারা মিয়া ও নাসির উদ্দিন চৌধুরীর ওপর ব্যক্তিগত নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হল যাতে তারা কোনো ছাত্রছাত্রীর সাথে আলাপ আলোচনা না করতে পারে। উদ্যোক্তারা পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য গোলাপগঞ্জ সম্মেলনের ভেন্যু ঘোষণা কওে পুলিশের চোখে ধূলো দিয়ে চলে যান ফেঞ্চুগঞ্জ। সেখানে পুলিশ উপস্থিত হওয়ার আগেই সম্মেলনের উদ্বোধন হয়ে যায় এবং এক অভূতপূর্ব পদ্ধতিতে সম্মেলনের প্রস্তাবাবলি পাশ হয়। জন্ম নেয় সিলেট জেলা ছাত্র ইউনিয়ন নামে একটি অসাম্প্রদায়িক ছাত্র সংগঠন।
আসদ্দর আলী সে সময় প্রকাশ্যে যুবলীগ করতেন। অপ্রকাশ্যে ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য। যুবলীগের দফতর ছিল জিন্দাবাজারে, এখন যে স্থানে শুকরিয়া মার্কেট অবস্থিত সে স্থানে একটি কাঠের দোতালায়। সে ঘরটি ছাত ইউনিয়নের অফিস হিসেবেও ব্যবহৃত হত। রাতের বেলা সে অফিস ঘরটি হয়ে দাড়াত আস্তানা। যে সব পূর্ণকালীন কর্মীর থাকার কোনো স্থায়ী ঠিকানা ছিল না, তারা সে ঘরেই রাত্রি যাপন করতেন। রান্নাবান্নার জন্য ব্যবহৃত হত কেরোসিনের স্টোভ। এ ঘরে আসাদ্দর আলী, তারা মিয়া ও ওয়ারিছ আলীকে রাত্রি যাপন করতে দেখেছি। মাঝে মধ্যে তারা অন্য শুভানুধ্যায়ীদের বাসায় লজিংয়ে থাকতেন। সেখানে অসুবিধা হলে এ ঘরটিই ছিল তাদের ঠিকানা।
আমি মেট্রিক পরীক্ষা দেবার জন্য নির্বাচনী পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পরই ভাষা আন্দোলন শুরু হয়।
আসাদ্দর আলী তাজপুরে এসে আমাদেরও সে আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত করেন। বস্তুতঃ তাঁর মাধ্যমেই আমরা ঢাকায় গুলি বর্ষনের সংবাদ পাই এবং স্কুলে ধর্মঘট পালনের আয়োজন করি। রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলনের অংশ হিসেবে আমরা তাজপুর বাজারে সভারও আয়োজন করেছিলাম। পরে পুলিশী হয়রানির মুখে আমি এলাকা ছেড়ে সিলেট শহরে চলে গেলে তাজপুরে আন্দোলনে ভাটা পড়ে।
মেট্রিকের ফল বেরুলে আমি এম.সি কলেজে আই এ ক্লাসে ভর্তি হই এবং ছাত্র ইউনিয়নের সক্রিয় কর্মী হিসেবে বিবেচিত হতে থাকি। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে সিলেটে যে কমিটি গঠিত হয় আসাদ্দর আলী সে কমিটির যুগ্ম আহবায়ক নির্বাচিত হন। আমি তখন জেলা ছাত্র ইউনিয়নের সাধারন সম্পাদক হিসাবে নির্বাচনী কর্মকান্ডে অংশ নিই। মনে পড়ে কুলাউড়ার সৈয়দ আকমল হোসেনকে সাথে নিয়ে আমি নির্বাচনী সফরে মৌলভীবাজার গিয়েছিলাম এবং সৈয়দ সাহেবের জনপ্রিয়তার মাত্রা প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পেয়েছিলাম।
এ সময়ে আমি মীরাবাজার জেলা আনসার এডজুটেন্ট এর বাসায় জায়গীরে থাকতাম। আনসার অফিসের পাশে এক চিলে কোঠায় ছিল থাকার ব্যবস্থা। সারা দিনের নির্বাচনী কাজ কর্ম সেরে প্রায়ই আমার বাসায় রাত্রি যাপন করতেন আসাদ্দর আলী। আবার সকালে উঠে চলে যেতেন। আমার ওপর আরেকটি কাজের দায়িত্ব ছিল। যে সব নেতৃবৃন্দ ঢাকা থেকে আসতেন এবং গোবিন্দচরণ পার্কে জনসভা করতেন তাঁদের সভার রিপোর্ট লিখে আমি বিভিন্ন সংবাদপত্রে পাঠাতাম। একবার এসেছিলেন চাটগাঁর বিখ্যাত কবিয়াল রমেশ শীল। তিনি কবি গানের অনুষ্ঠান করেছিলেন এবং রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ওপর রচিত তাঁর একটি বিখ্যাত গান গেয়ে শুনিয়েছিলেন। সে অনুষ্ঠানে সিলেটের কবিয়াল ফনীভূষণ দাসও অংশ গ্রহণ করেন। ফণী বাবু যে একজন কবিয়াল সে খবর এর আগে আমাদের জানা ছিল না।
নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট মুসলিম লীগকে ধরাশায়ী করে নিরঙ্কুশ সংখ্যাধিক্য লাভ করে। অবিভক্ত বাংলার ভূতপূর্ব প্রধানমন্ত্রী এ কে ফজলুল হক পূর্ব বাংলার প্রধানমন্ত্রী (তখন মুখ্যমন্ত্রী বলা হতো না) হলেন। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের নানামুখী ষড়যন্ত্রের মুখে সে মন্ত্রীসভা দীর্ঘ স্থায়ী হলো না। দেশে ৯২ ক ধারার গভর্ণরের শাসন প্রবর্তিত হল। মনে পড়ে, সেদিন রাত প্রায় ১১ টার সময় আমার বাসায় থাকতে আসেন কমিউনিস্ট কর্মী অনিমেষ ভট্টাচার্য। এমনিতে তার থাকার ব্যবস্থা ছিল মাহমুদ আলীর বাসায় লামাবাজারে। অনিমেষ জানালেন যে সেদিন রাতেই দেশে গভর্ণরের শাসন জারি হতে চলেছে। তাই তিনি আত্মগোপনে চলে যাচ্ছেন। সে রাতটি তিনি আমার সাথে কাটাতে চান। খুব ভোরে উঠে চলে যাবেন। তিনি আমাকে দু’টি খাম বন্ধ চিঠি দিয়ে এর একটি হাজেরা মহমুদ এবং অন্যটি
আসাদ্দর আলীকে পৌঁছে দিতে বললেন। তিনি জানালেন যে আসাদ্দর আলী কাজিরবাজারে জালালাবাদ ব্যাচ ফ্যাক্টরির বাসায় আত্মগোপন করে আছেন।
কাকভোরে অনিমেষ চলে গেলেন। আমি একটু বেলা হলে চিঠি দুখানা পকেটে পুরে সাইকেলে রওয়ানা হলাম মাহমুদ আলীর বাসায়। সেখানে পৌঁছে জানতে পারলাম যে আগের রাতে মাহমুদ আলী গ্রেফতার হয়েছেন এবং অনিমেষের খোঁজে পুলিশ বাসা তছনছ করেছে। হাজেরা মাহমুদকে চিঠিখানা দেবার পর যখন তাঁর বৈঠকখানায় বসে আছি তখনই সেখানে হাজির হলো স্থানীয় লামাবাজার ফাঁড়ির পুলিশ। উদ্দেশ্য হাজেরা মাহমুদের গ্রেফতর। হাজেরা মাহমুদের উপস্থিত বুদ্ধির প্রয়োগে আমি গ্রেফতারি এড়াতে সক্ষম হই। সেখান থেকে শেখঘাট পৌঁছে আসাদ্দর আলীকে চিঠিখানা দিই এবং সেই ঘটনার বিবরণও দিই। তিনি আমাকে সাবধানে থাকার উপদেশ দিয়ে বিদায় করলেন। আমি নদীর পারের রাস্তা দিয়ে কালিঘাট ঘুরে বাসায় ফিরলাম। আর তক্ষুনি বন্ধু মুমিত খান টেকনিক্যাল স্কুল রোড থেকে এসে হাজির হলেন। তিনি জানালেন যে সেখানে এক চা স্টলে পুলিশের গোপন শাখার এক লোক নাকি আমার ঠিকানার বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছিলো। একথা শুনেই তিনি ছুটে এসেছেন। সুতরাং ধরে নেয়া গেল যে আমাকেও গ্রেফতার করা হবে। তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে আমি জরুরী কাজে বাড়ি যাবার কথা বলে বেরিয়ে পড়লাম। তখন বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিলো। সেই সুযোগে আমি মৌলভীবাজার বাস স্টেশনে পোঁছে সত্যি সত্যি বাড়ি চলে গেলাম। এরপরে পুলিশ আমাকে খোঁজাখুঁজি করছে এ খবর পেতাম বন্ধু আব্দুল মছব্বিরের মাধ্যমে।
মাস খানেক পর একদিন সাহস করে পোষাক পরিচ্ছদ পরিবর্তন করে শহরে চলে এলাম। আসাদ্দর আলীর খোঁজ নিতে গেলাম সৈয়দ মোতাহির আলীর পাক বিস্কুট ফ্যাক্টরি নামক দোকানে। তিনি বললেন বেল ১টার দিকে াবার যেতে। তখন তিনি একজন লোক সঙ্গে দিয়ে আমাকে পাঠাবন াসাদ্দর আলীর গোপন আস্তানায়। বেলা ১টার সময় সৈয়দ সাহেবের দোকানের কিছু দূরে থাকতেই দেখি দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে পুলিশের ইনটেলিজেন্স বিভাগের একজন পরিচিত লোক। তখন আর না এগিয়ে ফিরে গেলাম বাসে করে নিজ গ্রামে। এর দিন কয়েক পরে আম্বরখানায় এক গোপন আস্তানা থেকে অন্য এক স্থানে যাওয়ার পথে আসাদ্দর আলী গ্রেফতার হয়ে যান।
এ ঘটনার কিছু দিন পরে গ্রেফতারির কড়াকড়ি উঠে গেলে আমার গ্রেফতার হওয়ার সম্ভাবনা দূর হয়। ইতোমধ্যে আমার আই এ পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হলে আমি ঢাকা বিশ্বদ্যিালয়ে ভর্তি হতে চলে যাই। সেই সাথে সরে পড়তে বাধ্য হই সক্রিয় রাজনীতি থেকে। কিন্তু আসাদ্দর আলীর সাথে যোগাযোগ ছিন্ন হয়নি। জেল থেকে মুক্তি পেয়ে তিনি আস্তানা গাড়েন সৈয়দ মোতাহির আলীর বাসায়। আমি ঢাকা থেকে সিলেট আসলে সে বাসায় আতিথ্য গ্রহণ করতাম। তিনি পরিবারের একজন সদস্যের মতই সে বাসায় থাকতেন। তার অতিথিদের আপ্যায়ন করতে হত সৈয়দ গিন্নীকে। সৈয়দ মোতাহির আলী ছিলেন একজন বই পড়–য়া লোক। প্রচুর ভালে বইয়ের কালেকশন তার ছিল। তাঁর কাছে থেকে বই ধার নেবার জন্যও অনেক সময় সে বাসায় যেতাম। সৈয়দ সাহেব আমাকে স্নেহের চোখে দেখতেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার পাট চুকিয়ে প্রথম চাকুরি নিলাম মদনমোহন কলেজে। থাকতাম টেকনিক্যাল স্কুল রোড ব্যবসায়ী বন্ধু মুমিত খানের সাথে। আর খাওয়া দাওয়া চলত হোটেল। তখন দেশে তখন রাজনীতি নিষিদ্ধ। পুলিশী দৃষ্টিকে ফাঁকি দোবার জন্য আসাদ্দর আলী তখন হয়ে গেলেন হোমিওপ্যাথিক প্র্যাকটিশনার। বিকাল বেলা বসতেন হোমিওপ্যাথ ডাঃ মালিকের স্টেশন রোডের ডিসপেনসারিতে। দু’জনে মিলে রোগী দেখতেন। এবার নায্যভাবেই আগে ডাক্তার যোগ করা যেতো কিন্তু তাঁকে কেউ সে নামে ডাকতে শুনিনি। আমি বিকেলে বেড়াতে বের হলে আসাদ্দর আলীর চেম্বারে অনেক সময় ঢুঁ দিতাম। কিছুদিন পরে আমি ডাঃ মালিকের বাসায় পেয়িং গেস্ট হিসাবে আস্তানা পরিবর্তন করি। সেখানে থাকাকালীন হঠাৎ খুবই অসুস্থ হয়ে পড়লে আসাদ্দর আলী ২/৩ দিন সেখানে থেকে আমার শুশ্র“ষা করেন। এসব কারণে সরকারের আই বি বিভাগের ধারনা হয় যে আমি আসাদ্দর আলীর সাথে রাজনৈতিক সম্পর্কে জড়িত। আমি প্ল্যানিং কমিশনে একটি চাকুরী পেলে পুলিশ ছাড়পত্র না দিয়ে সেটা আটকে দেয়। পরে সিলেট ছেড়ে পাবনা চলে গেলে সরকারি কলেজে চাকুরীর জন্য নির্বাচিত হই। কিন্তু সেক্ষেত্রেও পুলিশ ছাড়পত্র দীর্ঘদিন আটকে রেখে আমার চাকুরী প্রাপ্তিতে বিলম্ব ঘটায়। এতেও এর জের মেটেনি। আমি সরকারি বৃত্তি নিয়ে বিদেশ যাওয়ার জন্য পাসপোর্ট চাইলে সেটাও দীর্ঘদিন আটকে রেখে হয়রানি করে। শেষ পর্যন্ত সরকারি চাকুরীর জোরে পুলিশী ছাড়পত্র ছাড়াই ইমারজেন্সি পাসপোর্ট নিয়ে বিলাত যাই।
বিলাত থেকে ফেরার পরে আমার সাথে
আসাদ্দর আলীর দেখাসাক্ষাৎ কম হতো। ঊনসত্তরের ‘গণআন্দোলনের সময় আমি কুমারপাড়ায় বসবাস করতাম। তখন অনেকদিন সন্ধ্যার পওে তিনি আমার বাসায় আসতেন। নানা বিষয়ে গল্পগুজব কওে রাত ন’টার দিকে অন্য কোথাও গোপন সভায় যোগ দিতে চলে যেতেন। এ সময় তাদের দলের ভাঙ্গন সম্পূর্ণ হয়েছে। আসাদ্দর আলী পিকিংপন্থি এবং পীর হবিবুর রহমান ও তারা মিয়া মস্কোপন্থি দলে বিভক্ত। দেশব্যাপী গণঅভ্যূত্থানের সময় মাঝে মাঝে কিছু লিফলেট পাওয়া যেতো। ওই সবে গ্রাম থেকে শহর ঘেরাও করার কথা উল্লেখ থাকতো। আসাদ্দর আলীর সাথে আলাপ আলোচনায় বুঝা যেতো এসব তাঁর দলের কান্ড। আমি তাঁকে একদিন সরাসরি জিজ্ঞেস করে বসলে তিনি জানালেন যে তাঁদেও লোকজনদের গেরিলা ট্রেনিং প্রদান করা হচ্ছে। কোথায় সে কথা জিজ্ঞেস করলে জানালেন গোয়াইনঘাট এলাকায়। এরপর আমি কুমারপাড়া ছেড়ে গেলে দীর্ঘ দিন তাঁর সাথে দেখা সাক্ষাৎ হয়নি। কখনো শহওে যাবার পথে তাঁর বাড়িতে নেমে ভালো মন্দ খবরাখবর জেনে নিতাম। তিনি তখন ধোপাদীঘির পূর্বপাড়ে নিজস্ব বাসায় থিতু হয়েছেন।
এরপর আসে মুক্তিযুদ্ধ। এ সময় আসাদ্দর আলীর পিকিংপন্থি দলে আরো ভাঙ্গন দেখা দেয়। এক অংশ তোয়াহার নেতৃত্বাধীন ও অন্য অংশ আব্দুল হকের নেতৃত্বাধীন ভাগ হয়ে যায়। আব্দুল হক মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধাচরণ করেন। এমনকি মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে ভূট্টোর সাথে সরাসরি চিঠি চালাচালি করেছেন বলে গণমাধ্যমের খবরে জানা যায়। তোয়াহাপন্থিদেরও নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। পরে তোয়াহা সাহেব নতুন দল গঠন করেন- সাম্যবাদী দল। আসাদ্দর আলী সাম্যবাদী দলের মুখপত্র গণশক্তি সম্পাদনাও করেছেন। সে সময় তিনি ঢাকায় আস্তানা পরিবর্তন করেছিলেন এবং দলের উচ্চ পর্যায়ের বিভিন্ন পদে বৃত হয়ে ছিলেন। স্বাধীনতাত্তোর কালে আসাদ্দর আলীর সাথে আমার যোগাযোগ তেমন ছিল না। আমি চাকুরি জীবনে বেশ কিছুদিন বাইরে কাটাই এবং সে অবস্থায়ই রাজশাহী থাকা অবস্থা তাঁর তিরোধানের সংবাদ পাই।
আসাদ্দর আলীর সাথে যখন আমার পরিচয় ঘটে তখন আমি নিতান্ত কিশোর। তিনি সেই কিশোর মনে যে বৈপ্লবিক চেতনা সঞ্চার করে দিয়েছিলেন তা আমার মনে সূদূর প্রসারী প্রভাব ফেলে। এ অর্থে তাঁকে আমার রাজনৈতিক গুরু বললেও অত্যুক্তি হবে না। পরবর্তীকালে অবশ্য আমি রাজনৈতিক বলয়ের বাইওে চলে গেলে তাঁর মতামতের সাথে অন্বয় রহিত হয়ে পড়ি। তবে আমি তাঁকে একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে শ্রদ্ধার চোখে দেখে এসেছি। তিনি ছিলেন একজন তাত্ত্বিক এবং সব সময় ছিলেন ঐক্যেও পক্ষে। বিবদমান কমিউনিস্টপন্থিদের মধ্যে সমন্বয় ঘটাতে তিনি যারপরনাই প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন। কিন্তু তাঁর সে চেষ্টা ফলপ্রসূ হয়নি।
আসাদ্দর আলী ছিলেন একজন দায়বদ্ধ রাজনৈতিক নেতা। দেশ ও জনগণের স্বার্থের পরিপন্থি কোনো কাজে তিনি কখনও নিজেকে জড়াননি। তাঁর বিশ্বাসে তিনি ছিলেন অটল। তিনি নিজে একজন প্রতিশ্রুতিশীল কবি ও গল্পকার হলেও নেহাৎ প্রচার বিমুখীনতার কারণে তাঁর সে প্রতিভা বিকাশের সুযোগ পায়নি। কিন্তু অন্যকে তিনি সব সময় উৎসাহ দিতেন। এখন মনে পড়লে আমার হাসি পায়- আসাদ্দর আলীর পাল্লায় পড়ে আমিও কিছুদিন কবিতা লেখার চেষ্টা করেছিলাম। তিনি আমাকে কবিতা লেখার শৈলী শেখাতে চেষ্টা করেছিলেন। কবি দিলওয়ারের স্ফুটনোন্মুখ প্রতিভা বিকাশের ক্ষেত্রেও তাঁর অনুপ্রেরণা ক্রিয়াশীল ছিল বলে আমার ধারনা।
আসাদ্দর আলী ছিলেন একজন নিঃস্বার্থ ও নির্লোভ দেশপ্রেমিক। তাঁর মতো লোক আমাদের সমাজে খুবই বিরল। তিনি আজীবন দেশের জন্য কাজ করে গেছেন কিন্তু নিজের জন্য কিছুই করেননি। রাজনীতি করবেন বলে সরকারী চাকুরি ছেড়ে রাজপথকে বেছে নিয়েছিলেন। অথচ তিনি ছিলেন একজন নি¤œবিত্ত কৃষিজীবী পরিবারের সন্তান। স্বাভাবিক নিয়মে তাঁর পরিবার পরিজনের মুখ চেয়ে একটি সুবিধাবাদী ক্যারিয়ার গড়ে তোলাই ছিল সঙ্গত। কিন্তু তিনি সে ধাতুতে তৈরী ছিলেন না। তিনি ব্যক্তি স্বার্থকে জাতীয় স্বার্থের যূপকাঠে বলি দিয়ে এক সর্বত্যাগী জীবনের পথ বেছে নিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন খুবই মেধাবী। বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর পড়াশোনার ব্যাপ্তি ছিল অসাধারণ। কিন্তু রাজনীতি ছিল তাঁর প্রথম ভালবাসা। তাই রাজনীতির প্রেমকে উপেক্ষা কওে সময়মত জীবন সঙ্গিনী খুঁজে নিতেও ছিলেন না উদগ্রীব। জীবনের দুই তৃতীয়াংশ তিনি কাটিয়ে দেন সংসার ত্যাগী সন্ন্যাসীর মতো। শেষ বয়সে সংসারী হলেও সংসার তাঁকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলতে পারেনি। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত দেশ ও দশের কল্যাণ চিন্তা থেকে বিচ্যুৎ হননি। তিনি ছিলেন মেহনতি মানুষের প্রাণপ্রিয় কমরেড। তিনি চিরদিন আমাদের তরুণ সমাজের অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবেন।।
মো: আব্দুল আজিজ: প্রাক্তন কোষাধ্যক্ষ, শাবিপ্রবি, সিলেট, প্রফেসর মেট্রো-পলিটান বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।
( কমরেড আসাদ্দর আলী স্মারক গ্রন্থ থেকে সংগ্রহীত)