Feature Label 3

0

 
কমরেড আসাদ্দর আলী ,আসাদ্দর আলী ,কমরেড আসদ্দর আলী, আসদ্দর আলী,কমরেড আছদ্দর আলী,আছদ্দর আলী,মনির উদ্দিন আহমদ,ভাষা আন্দোলন সিলেট,বাংলাদেশ সাম্যবাদী দল,তাজ পুর কলেজ,কমরেড আসাদ্দর আলী স্মৃতি পরিষদ,comrade asaddar ali,asaddar ali,assador ali,comradessador ali,leader asador ali

কমরেড আসাদ্দর আলী এক বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বসম্পন্ন রাজনীতিবিদ ছিলেন। বিশিষ্ট কিছু ব্যক্তি ছাড়া একজনের মধ্যে একাধিক গুনের সমাবেশ
আমরা খুবই কম দেখি। কিন্তু আসাদ্দর আলী ছিলেন তার ব্যতিক্রম। তিনি ছিলেন একাধারে রাজনীতিবিদ, রাজনীতির শিক্ষক, কবি,
লেখক, জনদরদী, জনগণের সেবক। তাঁর রাজনৈতিক আদর্শ ছিল সমাজের সকল অত্যাচার, শোষণ, নির্যাতনের অবসান করে এবং বর্তমান
শোষণ ভিত্তিক সমাজ গুঁড়িয়ে দিয়ে শোষণহীন ও সাম্যভিত্তিক এক নতুন সমাজ প্রতিষ্ঠা। তাঁর আদর্শকে এক কথায় প্রকাশ করতে গেলে
প্রখ্যাত সাম্যবাদী কবি সুকান্তের বিখ্যাত কবিতা ‘ছাড়পত্রের’ কথা মনে পড়ে। সুকান্তও ছিলেন বিপ্লবী। পারিপার্শ্বিক সমাজের অবস্থা তাকে
যেমন ব্যথিত ও বিদ্রোহী করেছিল, তেমনি করে কমরেড আসাদ্দর আলীকেও এই সমাজের সকল নির্যাতন, শোষণ বিদ্রোহী করে নতুন
সমাজ গড়ার আদর্শে অনুপ্রাণিত করে। সুকান্ত তাঁর বিখ্যাত ‘ছাড়পত্র’ কবিতায় বলেছেন :
চলে যেতে হবে আমাদের
চলে যাবো- তবু যতক্ষণ দেহে
আছে প্রাণ
প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য
করে যাব আমি
নবজাতকের কাছে এ আমার
দৃঢ় অঙ্গীকার।
আসাদ্দর আলীর প্রতিজ্ঞা ও অঙ্গীকার ছিল নতুন বাসযোগ্য পৃথিবী গড়ার। এই লক্ষ্যে ছাত্র অবস্থা থেকে মৃত্যুও আগ পর্যন্ত তিনি দ্বিধাহীন চিত্তে লড়ে গেছেন তার আদর্শ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে। সমাজতন্ত্রই মানুষের মুক্তির একমাত্র পথ- এই ছিল তার দৃঢ় বিশ্বাস।
আসাদ্দর আলী শুধু রাজনীতিবিদ ছিলেন না- তিনি ছিলেন একজন রাজনীতির শিক্ষক। তার সংস্পর্শে যারা আসত তাদের তিনি রাজনৈতিক ভাবে সচেতন ও সমাজতান্ত্রিক আদর্শে অনুপ্রাণিত করার চেষ্টা করতেন। এই প্রচেষ্টায় তিনি বন বিভাগে চাকুরি করেন। তখন নাকি কর্তব্য পালনের সময়ও গাছের নীচে বসে কবিতা লিখতেন। তিনি গান লিখতেন- যখনই তার ভাব আসত তখনই সম্মুখে যে কাগজ পেতেন তাতেই তিনি গান লিখতেন। আমি তার টেবিলে একটা কাগজে দু-একটা গানের কলি দেখেছি। এই গানগুলি তার নিজস্ব না অন্য কোন গণ সঙ্গীতের অনুকরণে লিখা তা বলতে পারবনা।
আসাদ্দর আলী শিক্ষাপ্রসারেও অগ্রণী ভূমিকা রাখেন, বিশেষ করে তাঁর প্রচেষ্টায় তাজপুর কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়।
আসাদ্দর আলীর সঙ্গে আমার পরিচয় আজ থেকে প্রায় ৫৫ বছর আগে। তখন তিনি মদনমোহন কলেজের বি.এ শেষ বর্ষের ছাত্র। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টি ছিল কার্যত বেআইনি। ফলে তারা আত্মগোপন করে যারা তাদের সাথে সম্পর্কিত ছিলেন তাহাদের মারফতে কাজ চালাতে থাকেন। সেই সময় আমরা যারা পার্টির সাথে সম্পর্কিত ছিলাম, কাজের সুবিধার জন্য শহরে একটি কমিটি গঠন করি- যা পার্টি কর্তৃক বিশেষ কমিটির মর্যাদা লাভ কর। সেই কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন আসাদ্দর আলী। এভাবেই আমাদের পরিচয় ও কাজের মধ্য দিয়ে তা আরও ঘনিষ্ঠ হয়। আমরা ছিলাম একই পরিবারের সদস্যের মত। তৎকালীন আত্মগোপনে থাকা কমিউনিস্ট পার্টির জেলা কমিটির সম্পাদক রুহিনীদা (তাহির ভাই) আমাদের সাথে যোগাযোগ রাখতেন ও নানাভাবে আমাদের কর্তব্য নির্ধারনে সাহায্য করতেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর সরকারের নানাবিধ জনবিরোধী কাজে প্রগতিশীল ছাত্র ও যুবকেরা হতাশ হয়ে পড়ে, কিন্তু কোন সংগঠন না থাকায় সংঘবদ্ধভাবে কিছু করতে পারছিলনা। এমনি এক পরিস্থিতিতে আমরা ছাত্রদের সংগঠিত করে একটি প্রগতিশীল অসাম্প্রদায়িক ছাত্র সংগঠন গঠন করার সিদ্ধান্ত নেই। কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয় কমরেড আসাদ্দর আলী ও তারা মিয়ার উপর। আসাদ্দর আলী ছিলেন বড় ধরনের সংগঠক ও মার্ক্সবাদে যথেষ্ট জ্ঞানের অধিকারী। অল্প দিনের মধ্যেই তিনি বিপুল সংখ্যক ছাত্রকে অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে সক্ষম হন এবং তা গঠনের জন্য একটা সম্মেলন আহবান করেন। সরকার ভীত হয়ে উক্ত সম্মেলনের উপর নিষেধাজ্ঞা জারী করে ক্ষান্ত হয় নাই, অধিকন্তু আসাদ্দর আলী, তারা মিয়া, ও নাসির উদ্দিনের উপর উক্ত কার্যক্রমের সাথে সকল প্রকারের যোগাযোগ রাখার উপর নিষেধাজ্ঞা জারী করা হলে সরকারের চোখকে ফাাঁকি দিয়ে একটি জায়গা বের করার ভার পড়ে আমার উপর। আমি বর্তমানে প্রখ্যাত আইনজীবী জনাব জালালউদ্দিনের সহায়তায় তাদের বাড়ির নিকটে বড় দুই টিলার আড়ালে সভাস্থান ঠিক করি। সিলেট জেলা ছাত্র ইউনিয়নই তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম অসাম্প্রদায়িক ছাত্র সংগঠন। এই সংগঠন গড়ার মধ্য দিয়ে আসাদ্দর আলীর সাংগঠনিক ক্ষমতা প্রকাশ পায়, ফলে তিনি ছাত্রদের চোখের মধ্যমণি হয়ে উঠেন।
পূর্বপাকিস্তান যুবলীগ প্রতিষ্ঠা লাভ করলে আমরা সবাই যুবলীগে যোগ দেই। এখানেও যুবলীগ জেলা কমিটি গঠিত হয়। উক্ত কমিটির সম্পাদক ও যুগ্ম সম্পাদক যথাক্রমে আমি ও আসাদ্দর আলী হই। আমি পাকিস্তান গণতন্ত্রী দলের জেলা সম্পাদক হওয়ায় আমার স্থলে আসাদ্দর আলী যুবলীগের সম্পাদক হন এবং দক্ষতার সাথে সাংগঠনিক কর্মকান্ড পরিচালনা করেন।
যুবলীগের সমর্থন পেলে পার্টি অসম্প্রাদায়িক গণতান্ত্রিক দল গঠনের উদ্যোগ নেয় এবং রাজশাহীর কমরেড আতাউর রহমানকে জনাব মাহমুদ আলীর সাথে যোগাযোগ করার দায়িত্ব দেন। মাহমুদ আলী সাহেবের নেতৃত্বে পাকিস্তানে প্রথম অসাম্প্রদায়িক গনতান্ত্রিক দল হিসেবে পাকিস্তান গণতন্ত্রী দল গঠিত হয়। এর সভাপতি নির্বাচিতি হন তেভাগা আন্দোলন খ্যাত হাজী মোহাম্মদ দানেশ ও সেক্রেটারী জনাব মাহমুদ আলী। সিলেটের সকল প্রগতিশীল যুবক উক্ত প্রতিষ্ঠানের দিকে ঝুঁকে পড়ে। কিন্তু কয়েক মাস পরই পার্টি থেকে নির্দেস আসে যে আওয়ামী মুসলীম লীগে যোগ দিতে হবে। ফলে কমরেড আসাদ্দর আলী,হাবিব মিয়া, তারা মিয়া গং আওয়ামী লীগে যোগ দেন। পরে স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে সোহরাওয়ার্দির সাথে মৌলানা ভাসানীর বিরোধ দেখা দেয় এবং মৌলানা ভাসানীর নেতৃত্বে পশ্চিম পাকিস্তানের সীমান্ত গান্ধী আব্দুল গাফফার খান,  পাঞ্জাবের মিয়া ইফতেখার উদ্দিন, সিন্ধু প্রদেশের জি.এম. সৈয়দ, বর্তমানে পাকিস্তানের বিদেশ মন্ত্রীর পিতা প্রখ্যাত ব্যারিষ্টার মিয়া মাহমুদ আলী কাসুরী ও পূর্ব পাকিস্তানের মাহমুদ আলী, অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ সহ সকল জননেতাকে নিয়ে পাকিস্তান আওয়ামী পার্টি গঠিত হয়। কমিউনিস্ট পার্টি আবার যারা আওয়ামী লীগে ছিলেন তাদের ন্যাপে যোগ দিতে নির্দেশ দেন।
ফলে আবার আমার সকলে একই দলে অর্ন্তভুক্ত হয়ে সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্তবাদ বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলন আরম্ভ করি। যেহেতু কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রিয় নেতৃত্ব জন বিচ্ছিন্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ছিলেন তাই তারা দোদুল্যমানতার শিকার হন। কখনও কোন সিদ্ধান্ত নিয়ে বেশিদিন ঠিক থাকতে পারেন নি। ফলে গণতান্ত্রিক আন্দোলন যতটুকু এগিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল তা বাস্তবায়িত হয় নাই। ন্যাপ গঠনের পর সিলেট জেলা কমিটি আমাকে সম্পাদক ও আসাদ্দর আলীকে যুগ্ম সম্পাদক করে গঠিত হয়।
মহান নেতা মার্শল স্টালিনের মৃত্যুর পর ক্রুশ্চেব ক্ষমতায় আসেন ও শান্তিপূর্ণভাবে সমাজতন্ত্র কায়েম করা যাবে বলে এক আকষ্মিক বক্তব্য দিলে আবার বিশ্বজুড়ে এক নতুন বিতর্ক সৃষ্টি হয়। আমাদের এখানে মনি সিংহ, বারীন দত্ত গং এর নেতৃত্বে পার্টির এক অংশ ক্রশ্চেবের নীতি সমর্থন করেন এবং কমরেড তোয়াহা, সুখেন্দু দস্তিদার (বশির ভাই) ও কমরেড আব্দুল হকের নেতৃত্বে অপর অংশ মনি সিংহ গং বক্তব্যের বিরোধী থিসিস দাখিল করেন। এই নিয়ে বিরোধের ফলে শুধু পার্টি নয় ন্যাপ সহ সকল গণসংগঠন দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। সিলেটে হবিব মিয়া (পীর হবিব), তারা মিয়া, আং হামিদ গং মনিসিংহদের সাথে যোগ দেন এবং আমি, আসাদ্দর আলী, সৈয়দ মোতাহির আলী গং কমরেড আলী গং কমরেড আং হক গং এর বিপ্লবী লাইনকে সমর্থন করি। পরে মাও সে তুংয়ের তিন বিশ্ব তত্ত্ব নিয়ে কমরেড আং হক, অজয় ভট্টাচার্য গং এর সাথে কমরেড তোয়াহা এর বিরোধ দেখা দিলে তাদের মধ্যে আবার ভাঙ্গন দেখা দেয়। কমরেড তোয়াহা, সুখেন্দু দস্তিদার এর নেতৃত্বে সাম্যবাদী দলের জন্ম হয়। আসাদ্দর আলী উক্ত দলে যোগ দেন। ফলে আমার সাথে তার মতপার্থক্য দেখা দেয়। মত পার্থক্য সত্ত্বেও আমাদের উভয়ের মধ্যে কোন অরাজনৈতিক দন্দ্ব বা বিরোধ ছিলনা। আমরা একে অন্যের বিশ্বাসকে সম্মান করতাম । মতপার্থক্য সত্ত্বেও তার সাথে আমার ঘনিষ্ট যোগাযোগ ছিল। বিভিন্ন রাজনৈতিক ইস্যুতে আমাদের স্ব স্ব অবস্থান থেকে আলাপ আলোচনা করতাম।
আসাদ্দর আলী ও আমি একবার একসঙ্গে বেশ কিছুদিন আত্মগোপন করে থাকি এবং ধরাও পড়ি একসঙ্গে। মে ১৯৫৪ সালের কথা। যুক্তফ্রন্টের বিশাল বিজয়ের পর শের-ই-বাংলার নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রীসভা ক্ষমতায় যায়। পাকিস্তানের শাসক ও শোষক গোষ্ঠি জনতার এই অভাবিত বিজয়কে মেনে নিতে না পেরে শেরে-বাংলার এক বক্তব্যের অজুহাত দেখিয়ে পূর্বপাকিস্তান মন্ত্রীসভা ভেঙ্গে দেয়। দেশে ৯২ক ধারা জারি হয়। সেদিন আমি, জনাব মাহমুদ আলী, শ্রমিক নেতা মরহুম মতছির আলী ছিলাম ছাতক সিমেন্ট কোম্পানীর লেবার ইউনিয়নের এক সভায়। ঐ দিন বিকালে সিলেট ফিরে জানতে পারি ‘৯২ক’ ধারা জারির কথা।
মাহমুদ আলী সাহেব তাঁর বাসায় পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। এই খবর পেয়েই আমরা আত্মগোপনে চলে যাই। আত্মগোপনে যাওয়ার কয়েকদিন পরই আসাদ্দর আলীর সাথে আমার যোগাযোগ হয় এবং আমরা একসঙ্গে আবার সিদ্ধান্ত নিয়ে সুরমা নদীর দক্ষিণ পাড়ে চলে যাই। মেন্দীবাগের নিকট নদীর তীরে একটা ছোট গ্রাম যার প্রায় সকলেই মৎসজীবী। তিনি আমাদের ঐ গ্রামের একটু অবস্থাসম্পন্ন একজনের বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করে দেন। সেখানে এসে নুরুর রহমান সাহেবও আমাদের সাথে যোগ দেন। তাকে নিয়ে মস্ত বিপদে পড়ি। তিনি খুবই দীর্ঘদেহী ছিলেন। বেশ দূরে থেকেই তাকে চেনা যেত। তাই আমরা সেই আশ্রয় ছেড়ে নৌকায় আশ্রয় নেই। একদিন নৌকা কাজিরবাজার ঘাটে কিছু খাওয়ার জিনিস কেনার জন্য ভিড়ায়। মাঝি কিছু না পেয়ে শুটকি কিনে নিয়ে আসে। আসাদ্দর আলী পাকের দায়িত্ব নিয়ে শুটকি পাক করলেন। আমরা খাওয়ায় বসে দেখি যে এই শুঁটকিতে নারিকেল তৈলের গন্ধ মুখে দেওয়ার অযোগ্য। তিনি অন্য তেল না থাকায় নুরুর রহমান সাহেবের সাথে থাকা এই নারিকেল তৈলের সদ্বব্যবহার করেছিলেন।
নুরুর রহমান এর পর আমাদিগকে রেখে তার বাসায় চলে যান ও ঐ দিনই গ্রেফতার হন। আমরা দুজন তখন নৌকা ছেড়ে আশ্রয়ের জন্য তেলিরাইয়ের দিকে রওয়ানা হই। ঐ রাস্তা এত কাদাযুক্ত ছিল যে চলাই মুশকিল। আমরা হাটুর উপর কাপড় তুলে হাত ধরাধরি করে অতি কষ্টে আসাদ্দর আলীর এক ভক্তের বাড়িতে যাই। ঐ ব্যক্তি ছিলেন আমাদের এক কর্মী। আমরা দুজনই আশ্রয়ের জন্য কত জায়গায় গিয়েছি তার ইয়ত্তা নাই। শেষ মেশ আমরা শহরে ফিরে আসি ও আবার আলাদা হয়ে পড়ি। পরে আবার যোগাযোগ হয় এবং আমি আশ্রয় স্থলে যাই। আমরা আবার শহর ছাড়া পরিকল্পনা নেই এবং ঐ দিন শহর থেকে নদীর দক্ষিণ পাড়ে যাওয়ার জন্য দুজন এক রিক্সায় আম্বরখানার নিকটবর্তী এক বাসা হতে রওয়ানা হই। আমরা যখন আম্বরখানা ছেড়ে চৌহাট্টা পৌঁছি-তখন দেখি যে একজন লম্বা কুর্ত্তা ও মাথায় জিন্নাহ টুপি, সাইকেলে আমাদের পিছু পিছু আসছে। আমারা দুজনই পিছু ফিরে দেখেও কিছু বুঝতে পারিনি। জিন্দাবাজার আসার পর ঐ লোক আমাদিগকে অতিক্রম করে সামনে চলে যায়। আমরা বন্দরবাজার পুলিশ-ফাঁড়ির সামনে যাওয়া মাত্র ঐ ব্যক্তি সাইকেল দিয়ে আমাদের গতি রোধ করে পুলিশ পুলিশ বলে চিৎকার আরম্ভ করা মাত্র চারিদিক থেকে ৮/১০ জন পুলিশ ও গোয়েন্দা আমাদের ঘিরে ফেলে। থানায় রাত্রিযাপনের পর আমাদের ঠিকানা হয় সিলেটের কেন্দ্রিয় কারাগারে। সেখানে গিয়ে দেখি জমজমাট কান্ড। আমাদের প্রায় সকলেই সেখানে অবস্থান নিয়েছেন।
তখন দেখি যে রাজবন্দিদেরকে দুই ভাগে আলাদা কওে রাখা হয়েছে। একটি সফট ক্যাম্প অন্যটি হার্ড ক্যাম্প। সফট ক্যাম্পে আওয়ামীলীগের, কংগ্রেস ও হার্ড ক্যাম্পে কমিউনিষ্ট, গণতন্ত্রী দলের কর্মীরা। আমাকে নেওয়া হয় হার্ড ক্যাম্পে- আসাদ্দর আলীর পেটের ব্যাথা বেড়ে যাওয়ায় তাকে জেল হাসপাতালে রাখা হয়। মাস দুয়েক পর আমাকে আরো পাঁচ জন সহ ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে বদলি করা হয়। আমার সাথে ছিলেন কুলাউড়ার ভাসানী খ্যাত সৈয়দ আকমল,  আজমিরীগঞ্জের (হোমিও) কৃপেন্দ্র ডাক্তার, অর্ধেন্দু বর্মন, ভারত সরকার ও এক হাজং কমিউনিষ্ট কর্মী।
আসাদ্দর আলী সাহেবকে অসুখের জন্য কয়েকমাস পর ছেড়ে দেয়- যারা আওয়ামী লীগ করতেন তাদেরও কয়েকমাসের মধ্যে ছেড়ে দেয়। রয়ে যাই শুধু আমরা। এক বৎসর পর আমি মুক্তিলাভ করি এবং সরকার আমাকে এক বছরের জন্য সিলেট মিউনিসিপাল এলাকার মধ্যে অন্তরীণ থাকার আদেশ দেয়। বেগম হাজেরা মাহমুদকেও ছয় মাসের উপর অন্তরীন আদেশ জারী করা হয়।
কমরেড আসাদ্দর আলী মৃত্যুও পূর্ব পর্যন্ত তার আদর্শকে প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করে গেছেন। তাঁকে সরকার কতটুকু ভীতির চক্ষে তার একটা নমুনা বলছি। আমি আমাদের মধ্যে আদর্শিক মতের অনৈক্য থাকা সত্ত্বেও তার বাসায় সময় সময় যেতাম। আমি তখন সিলেট জেলার সরকারী কৌশুলী- মেয়াদ অন্তে আবার আমার নাম জজ সাহেব সুপারিশ করেন। কিন্তু যেহেতু আসাদ্দর আলীর সাথে আমার যোগাযোগ ছিল তাই পুলিশ আমার সম্মন্ধে লিখে যে ‘যদিও তিনি সক্রিয় রাজনীতিতে নেই তবুও শহরের কমিউনিষ্টদের বিশেষ করে কমরেড আসাদ্দর সাহেবের সাথে তাঁর ঘনিষ্ট যোগাযোগ রয়েছে, ফলে যা হবার তা হয়েছে। আমি কমরেডের সাথে যোগাযোগের দরুণ বিবেচনার অযোগ্য বিবেচিত হই।
কমরেড আসাদ্দর আলী বিরামহীন ভাবে সংগ্রাম করে গেছেন তার আদর্শেও জন্য। তিনি সব সময়ই অসুখে ভুগতেন। কবি নজরুল ইসলামের এক কবিতার দুটি পক্তি যেন তার জীবনের লক্ষ্য ছিল। নজরুল লিখেছেন-
‘যেদিন উৎপীড়িতের ক্রন্দনরোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণভ’মে রনিবেনা
বিদ্রোহী রণক্লান্ত আমি সেই দিন হব শান্ত’।
মৃত্যু তাঁকে আমাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে। কিন্তু দুনিয়া ব্যাপী আজ সা¤্রাজ্যবাদ ও পুজিবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম শুরু হয়েছে।
মৃত্যুঞ্জয়ী সে আদর্শের মৃত্যু হয় না। যে দিন দুনিয়ার বুকে সর্বহারার রাজ কায়েম হবে সেদিন আসাদ্দর আলীর বিদেহী আত্মা শান্তি পাবে। আসাদ্দর আলী বিদেহী আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা জানাই।
সমাজতন্ত্র-জিন্দাবাদ
বিপ্লব-দীর্ঘজীবী হউক
রক্তের অক্ষরে একদিন শোধিত হবে তোমার ঋণ।
তোমার এককালের সহকর্মী।
মনির উদ্দিন আহমদ: প্রবীণ আইনজীবী, বিপ্লবী জননেতা ও সিলেট ল’ কলেজের অধ্যক্ষ।

Post a Comment

কমরেড আসাদ্দর আলী বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় নাম।তিনি সারাজীবন মেহনতী মানুষের কল্যানে কাজ করে গেছেন।১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে তার অবিস্মরণীয় অবদান ছিল।তিনি কমিনিষ্ট আন্দোলনের পথিকৃত এবং বাংলাদেশের সাম্যবাদী দলের সাবেক সভাপতি ছিলেন।গণ মানুষের নেতা কমরেড আসাদ্দর আলীর স্বরনে একটি ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা মাত্র।সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ।