আমার স্বামী মরহুম জননেতা আসাদ্দর আলী সাহেবের স্মরণে স্মারকগ্রন্থ বেরুবে শুনে উদ্যোক্তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতাবোধ জাগ্রত হবার সাথে সাথে মরহুমের সাথে আমার দীর্ঘ ১৩ বছরের দাম্পত্য জীবনের মধুময় স্মৃতি খচ করে বুকের গহীন কন্দরে বেদনার তীর হয়ে বিধে গেল।মরহুমের তিরোধানের পর থেকে তার প্রতি শ্রদ্ধা ভালবাসার যে সবুজ বৃক্ষটি চেতনার শ্যামল জমিতে এতো দিনে পত্র পুস্পে পূর্ণাবয়নে হিল্লোলিত ছিলো,আজ তা নষ্টালজিয়ার উত্থাল তরঙ্গ হয়ে স্মৃতির বন্ধ কুটিরে আঘাত হানতে উদ্যত হল। গন মানুষের সুখ- চিন্তায় যিনি জাগ্রত প্রহরী,দুখী জনতার অধিকার আদায়ে যিনি আপোষহীন,উদাসী পথিকের মত যিনি আত্নভোলা,স্বার্থ চিন্তায় আজীবন অনাগ্রহী,শ্রেণীহীন সাম্যবাদের প্রবক্তা,সেই ক্ষণজন্মা ব্যক্তিত্ব,আমার আরাধ্য পুরুষ মরহুম জননেতা আসাদ্দর আলী ছিলেন আমার দেখা সেরা মানুষ।তার সাথে আমার যখন বিয়ে হয়, তিনি তখন প্রৌঢ়ত্বের দ্বারে। আমিও তিরিশের কাছাকাছি।দাম্পত্য গড়ায় নিস্পৃহ জীবনে এই প্রায় প্রৌঢ় বরের আগমন ছিল আমার কাছেও অপ্রত্যাসিত।সিলেট শহরের কুমার পাড়া নিবাসী একদা মুসলীমলীগার ও পরে শ্রমীক লীগ নেতা মরহুম জনাব মতছির আলীর স্ত্রী ছিলেন আমাদের বিয়ের ঘটক।আমার হবু স্বামীর সাথে আমার পূর্ব পরিচিত ছিলো না।কেউ কাউকে জানতাম না।শুনেছিলাম আমার হবু স্বামী এ দেশের এক ডাক সাইটের ব্যাক্তি,যিনি গন মানুষের রাজনীতি করেন।
এমন মানুষটির সাথে ঘরকন্না কেমন হতে পারে তা ছিল আমার কাছে পুলক ও শিহরনে পরিপূর্ন।বিয়ের পর দেখলাম তিনি আজব এক দিলখোলা মানুষ।নিজেকে তিনি মজলুম মানুষের সেবক ভাবেন।অহংকার ও আত্মস্বার্থ থেকে তিনি অনেক দূরে।আমার পৈত্রিক নিবাস মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া থানার বরমচাল ইউনিয়নের নন্দনগর গ্রামের হাজী বাড়ীতে।আব্বার নাম আম্বর আলী,নানা মরহুম আজিম উল্লা ছিলেন জমিদার শ্রেণীর লোক।সিলেট আজিম উল্ল্যা ওয়াকফ এষ্টেট এখনো বিদ্যামান।আমি সম্পন্ন ঘরের মেয়ে হয়েও সাদাসিধে জীবন যাপন কারী এই সৌম্যকান্তি পুরুষের জীবনসঙ্গিনী হতে পেরে ইহজনম কে সার্থক ভেবেছি।তার নিজস্ব বাসা ছিল ধোপাদিঘীর পারে,যা তার মৃত্যুর পর এক সময় তারই ঘনিষ্টজনের হস্তগত হয়ে যায়।আমার মরহুম স্বামীর রাজনৈতিক মতাদর্শে আমি অনুপ্রানিত হয়ে ছিলাম স্বাভাবিক ভাবেই।আমাদের ধোপাদিঘী ও মধুশহীদস্থ বাসায় তার দলীয় নেতা কর্মীদের আনাগোনা ছিল সার্বক্ষনিক।আমার স্বামী ছিলেন দেশের বাম রাজনীতির অন্যতম পুরুধা ব্যাক্তিত্ব।সে হিসেবে তখনকার নেতৃস্থানীয় বাম রাজনীতিবিদদের মধ্যে মোহাম্মদ তোয়াহা,মনি সিংহ,অধ্যাপক আসহাব উদ্দিন ,দিলীপ বডুয়া,সহ সিলেটের তার নেতা কমীদের আনাগোনা ছিল আমাদের বাসায়।বলা বাহুল্য তাদের কে আমরা আপ্যায়ন করতাম সাদামাটা ভাবেই।আমার স্বামীর জীবন জাপন ছিল একে বারেই সহজ সরল।সাধারন পাজামা-পাঞ্জাবী,লুঙ্গী ও চাদর পরতেন,খেতেন মোটা চালের ভাত।সাধারন বাঙ্গালীর খাবার মাছ ভাত খেয়েই তৃপ্ত থাকতেন।ঢাকায় যেতেন ট্রেনের সাধারন কামরায়,ট্রেন ভ্রমনে তার খাবার ছিল চিড়া।টাকা কড়ি সঞ্চয় করতেন না ,চলতেন খুব সাধারন ভাবে।বিদেশ সফরে যেতে আমার কাছে অনুমতি চাইতেন।তার মধ্যে দাম্পত্য অধিকার বোধ ও দায়িত্ব জ্ঞান ছিল সমিহ করার মত।অসহায় দরিদ্র মানুষের প্রতি দরদবোধ ও ত্যাগ ছিল তার জীবনের এক বড় দিক।ভিক্ষুক এসে কিছু চাইলে পকেটে সব দিয়ে নিজে শুন্য হয়ে যেতেন।দানের পর তার মুখবয়বে লক্ষ্য করতাম স্বর্গীয় ঔজ্জল্য।তিনি অবসরে খুব পড়াশোনা করতেন।মওলানা মওদুদী সাহেবের বই থেকে শুরু করে মার্কীয় তত্বের বইয়ের নিষ্ঠাবান পাঠক ছিলেন।তিনি লিখতেন প্রবন্ধ,গল্প,ও কবিতা,গান ও লিখতেন মাঝে মাঝে।লোকে তাকে কবি সাব বলে সম্বোধন করতো।অবশ্য লেখা গুলো প্রায়ই হস্তলিপিতে সীমাবদ্ব থাকত,প্রকাশিত হতোনা।সর্বশেষ বিদেশ সফর থেকে ফিরে আসার পর তার লিভার সিরোসিস ধরা পড়লে তিনি মুষড়ে পড়েন।আসন্ন মৃত্যু চিন্তায় বিমর্ষ পুরুষ একদিন একটি গান লিখে আমার হাতে তুলে দেন।এটি একটি বিযোগান্তক গাথা।আমি ভেঙ্গে পড়ি।আজ এক যুগ পরেও আমার স্বামীর লিখিত সেই গান বুখে চেপে ধরে বেদনায় নীল হয়ে পড়্তিার প্রতি শ্রদ্বা ভালবাসায় আপ্লুত হয়ে স্রষ্টার কাছে আকুল প্রার্থনা জানাই - সেই শিশু সুলভ সরল ,স্নেহময় মানুষটিকে আল্লাহ বেহেস্ত দান করুন।আমিন
শহিদুন্নেছা শান্তি:মরহুম আসাদ্দর আলীর সহধর্মিনী।
কমরেড আসাদ্দর আলী স্মারক গ্রন্থ থেকে সংগ্রহীত
Post a Comment
0 comments
কমরেড আসাদ্দর আলী বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় নাম।তিনি সারাজীবন মেহনতী মানুষের কল্যানে কাজ করে গেছেন।১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে তার অবিস্মরণীয় অবদান ছিল।তিনি কমিনিষ্ট আন্দোলনের পথিকৃত এবং বাংলাদেশের সাম্যবাদী দলের সাবেক সভাপতি ছিলেন।গণ মানুষের নেতা কমরেড আসাদ্দর আলীর স্বরনে একটি ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা মাত্র।সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ।