আসলেই চলমান ঐ প্রক্রিয়ার সমাপ্তি ঘটেছিল ১৯৯০ সালের ২ ফেব্রুয়ারী এ মহান নেতার সর্বশেষ নিঃশ্বাসের মধ্য দিয়েই। মৃত্যুর ২/৩ দিন পূর্বেও আত্মগোপনকারী বর্ষীয়ান কমিউনিষ্ট নেতা কমরেড দ্বিজেন সোম তাঁকে কাজীটুলা উপসড়কস্থ অস্থায়ী ভাড়া বাসায় দেখতে গেলে শয্যাশায়ী অবস্থায় তিনি মুষ্টিবদ্ধ হাত উপরে তুলে ধরে লাল সালাম জানিয়েছিলেন তাঁর ফেলে আসা জীবনের এ সহযোদ্ধাকে। জননেতা আসাদ্দর আলী ছিলেন নানামুখী প্রতিভার সমন্বিত বহিঃপ্রকাশ। সুদর্শন এই লোকটি কখনো নিজ গুণাবলীর প্রতি মোটেই যত্নবান ছিলেন না। যার ফলে তাঁর মধ্যে নিহিত কোন নির্দিষ্ট একটি চরিত্র বিশেষত্ব হয়ে প্রকাশ পেল না, তিনি রয়ে গেলেন মিশ্রিত এক বহু প্রতিভাধর ব্যক্তিত্বের বাহক হিসেবেই। যদিও রাজনীতিবিদই হচ্ছে তাঁর মুখ্য পরিচয়, তাঁর সমসাময়িক ও পরবর্তী প্রজন্ম সমূহের ঘনিষ্ঠজনদের অনেককেই শুনেছি তাঁকে ‘কবি সাহেব’ বলে সন্বোধন করতে। এদের একজন হচ্ছেন প্রাক্তন ছাত্র ইউনিয়ন ও পরবর্তীকালের ন্যাপ (মোঃ) ও বর্তমানে বিএনপি রাজনীতিতে সংশ্লিষ্ট জনাব গুলজার আহমদ। কমরেড আসাদ্দর আলী সাহেব একজন অসাধারণ কাব্যগুণের অধিকারী ছিলেন। তাঁর সৃষ্ট কবিতা-প্রবন্ধে রাজনৈতিক শ্রেণী চেতনাবোধ প্রকাশ পেত সূঁচের মতো, যদিও সেগুলোকে কখনোই রাজনৈতিক স্লোগান বা লিফলেট বলে মনে হতো না। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ জেনারেল এরশাদ দেশে সামরিক শাসন জারী করে বিচারপতি আব্দুস সাত্তারকে বঙ্গভবন থেকে বের করে দিলে আমরা অনেকেই সমবেত হই আসাদ্দর আলী সাহেবের ধোপাদিঘীরপারস্থ বাসভবনে। সেদিন তিনি আমাদেরকে নিয়ে বাহিরের চৌচালা ঘরে না বসে ভিতরের ঘরেই বসলেন এবং স্বভাবসুলভ ভাবে বিছানায় কাত হয়ে অর্ধশুয়া অবস্থায় আমাদের সাথে আলাপ করতে লাগলেন। মুহূর্তের মধ্যেই ফেলে আসা পাকিস্তানী রাজনীতির দীর্ঘ ইতিহাসের মর্মকথা অতি সংক্ষেপে বিবৃত করলেন। কিভাবে পাকিস্তানের গণপরিষদ ভেঙ্গে দিয়ে আমলা গোলাম মোহাম্মদের অগণতান্ত্রিক শাসন জারী করা হয়েছিল, কিভাবে গণপরিষদের সভাপতি তমিজ উদ্দিন খানের দায়েরকৃত সিন্ধু হাইকোর্টের মামলা পাকিস্তান সুপ্রীম কোর্টে নাকচ হয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে পাকিস্তানী রাজনীতিতে অসাংবিধানিক ধারা অনুপ্রবেশ করলো সবই তিনি বলে ফেললেন এবং বুঝিয়ে দিলেন এটি বাংলাদেশের দ্বিতীয় সামরিক শাসন হলেও এর ধারাবাহিকতা সেই পাকিস্তানী রাজনীতির ২৫ বছর থেকে হিসেব কষতে হবে এবং এও ব্যাখ্যা করে দেখালেন যে, আসলে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ প্রকৃত অর্থে স্বাধীন হয়নি। পাকিস্তান নামের একটি নয়া উপনিবেশিক রাষ্ট্র থেকে যুদ্ধ করে বাংলাদেশ নামের আরেকটি নয়া উপনিবেশিক রাষ্ট্র সৃষ্টি হয়েছে মাত্র, রাষ্ট্রের শ্রেণী চরিত্রের কোন পরিবর্তন হয়নি এবং ক্ষমতায় দলের পরিবর্তন হলেও শাসক শ্রেণীর উৎখাত হয়নি। যার কারণে পুরাতন ধারাবাহিকতা অব্যাহত রয়েছে। তিনি প্রাসঙ্গিকভাবে বাংলাদেশের প্রথম সরকারের আমলে বাকশাল নামক একদল গঠন করে অপরাপর দলগুলোকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা সহ রক্ষীবাহিনী গঠন ও ঐ বিশেষ বাহিনীর উপর নির্ভর করে দেশ শাসনকেও সামরিক শাসনের সাথে তুলনা করলেন। সবকিছুর মধ্যে তিনি আমাদেরকে উৎসাহ দিয়ে বললেন পাকিস্তান ও বাংলাদেশ দু’আমলের রাষ্ট্রীয় ফরমান জারীর মধ্য দিয়ে দেশের রাজনৈতিক চর্চাকে কখনো বন্ধ করা যায়নি, বন্ধ হয়নি। এদেশের প্রগতিশীলরা প্রতিকূল পরিবেশে সদা সর্বদা অতীব ঝুঁকি’র মধ্যেও তৎপর থেকেছেন। প্রয়োজনে কৌশলে, কখনো গোপনে, কখনো সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের ভিতর দিয়ে রাজনীতিকে সচল রাখতে হবে এবং এটা হচ্ছে বাম রাজনৈতিক কর্মীদের ঐতিহাসিক দায়িত্ব। কমরেড আসাদ্দর আলীর সেদিনের তাৎক্ষণিক বক্তব্য সমবেতদেরকে উজ্জীবিত করে দিক নির্দেশনা দিয়েছিল এবং সামরিক আইনে ভীত না হতে অনুপ্রাণিত করেছিল। আমরা সেদিন তাঁর কথায় বাংলাদেশ লেখক শিবির এর মাধ্যমে কর্মকান্ড যৌথ ভাবে চালিয়ে যেতে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম এবং যতদিন রাজনৈতিক তৎপরতা নিষিদ্ধ ছিল ততদিন প্রধানত লেখক শিবিরের মাধ্যমেই আমরা সক্রিয় ছিলাম। তখন লেখক শিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি ছিলেন ডঃ আহমদ শরীফ এবং সাধারণ সম্পাদক ছিলেন শাহরিয়ার কবির। একবার মহান মে দিবস উপলক্ষে লেখক শিবিরের একটি প্রকাশনায় একটি লেখা দেয়ার জন্যে কমরেড আসাদ্দর আলীকে অনুরোধ করলে তিনি অনুপম একটি কবিতা লিখে দেন। যার নাম ছিল ‘লাল পতাকার জন্মদিনে’। মৃত্যু শয্যায় থেকে এক পর্যায়ে তিনি তাঁর নিজ কবরের এপিটাফ রচনা করে যান, সেটি হচ্ছে, ‘জীবনের তরে লড়ে যারা মরে, মৃত্যু নাই তাঁর’। কমরেড আসাদ্দর আলীর লেখক সত্ত্বা নিয়ে আরেকটি কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন। সামরিক শাসন আমলেই ২১ ফেব্রুয়ারীতে আমরা ‘ফাগুন’ নামে একটি পত্রিকা বের করি। পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলাম আমি নিজেই। সেখানে আসাদ্দর ভাই সিলেটের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস প্রসঙ্গে একটি বিরল মূল্যবান প্রবন্ধ লিখেছিলেন। বিভিন্ন পত্রিকায় গ্রন্থ সমালোচনা কলামে ঐ স্মরণিকার সমালোচনা করতে গিয়ে ঐ প্রবন্ধটির বহুবিধ প্রশংসা করেছিলেন অনেকেই। যেখানে লুপ্ত গোবিন্দ চরণ পার্কে ভাষা আন্দোলনকারীদের সমাবেশে মুসলিম লীগের গুন্ডাবাহিনীর আক্রমণের চাক্ষুষ বর্ণনাসহ হযরত শাহজালাল (রঃ) দরগাহ শরীফের তৎকালীন মতোয়াল্লী সরেকওম এ.জেড. আব্দুল্লাহ সাহেবের ভাষা আন্দোলনে পৃষ্ঠাপোষকতা প্রভৃতি বিবিধ বিষয় জীবন্তভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন তিনি। আমার কাছ থেকে ফাগুন পত্রিকাটির সংরক্ষিত সংখ্যাটি সাম্যবাদী দলের নেতা শ্রদ্ধেয় ধীরেন সিংহ নিয়ে যাওয়ায় এবং সেটি তিনি আর খোঁজে না পাওয়ায় ঐ গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাসময় প্রবন্ধটি চিরতরে হারিয়ে গেল। আমার চলার পথে অনেক বামপন্থী ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্যে যাবার সুযোগ হয়েছে, এদের মধ্যে কমরেড আব্দুল হক, অজয় ভট্টাচার্য, তোয়াহা, মতিন, আলাউদ্দিন, হাজী দানেশ, দেবেন শিকদার, আবুল বাশার প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। এদের অনেককেই হোমিওপ্যাথিক ঔষধ সেবন করতে দেখেছি। এদেশের কমিউনিষ্ট আন্দোলনের প্রবীণ ব্যক্তিদের অধিকাংশেরই রাজনীতির হাতেকড়ি হয়েছিল অগ্নিযুগের সংগঠন যুগান্তর এবং অনুশীলন এর ভিতর দিয়ে। যুগান্তর এবং অনুশীলন সংগঠনে কঠিন সংযম, অধ্যবসায় এর সাথে ভারতীয় সমাজের আদি বিষয়াদির চর্চা হতো। হোমিওপ্যাথি উপমহাদেশের আদিভিত্তিক না হলেও যুগান্তর-অনুশীলন সংগঠনে এর প্রচলন লক্ষ্য করা যায়। সেই ধারায় কমরেড আসাদ্দর আলীও ব্যতিক্রম ছিলেন না। তিনি ছিলেন একজন হোমিও চিকিৎসক। তাঁর ঘরে সব সময়ই কিছু হোমিওপ্যাথি ঔষধ থাকতো এবং লোকজনকে বিশেষ করে গরীব রিক্সাচালক, ফেরিওয়ালা ও মেহনতী মানুষকে তিনি বিনা পয়সায় হোমিও চিকিৎসা প্রদান করতেন। অনেককেই তাঁর কাছ থেকে হোমিও চিকিৎসা গ্রহণ করতে দেখেছি, আমি নিজেও দু’একবার কমরেড আসাদ্দর আলীর কাছ থেকে হোমিওপ্যাথি ঔষধ গ্রহণ করেছিলাম। সাংবাদিকতা, প্রেস ও প্রিন্টিং এর সাথেও জড়িত ছিলেন তিনি। আমরা শুনেছি একসময় সিলেট প্রিন্টার্স সিলেট শহরের নাইওরপুলে অবস্থিত ছিল এবং ঐ প্রিন্টার্স-কে কেন্দ্র করে পত্রিকা প্রকাশ ও প্রিটিং কাজে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন শ্রদ্ধেয় আসাদ্দর আলী সাহেব। জীবনের শেষাংশে তিনি বেশ কিছু দিন ঢাকায় অবস্থান করেন। তখন তিনি সাম্যবাদী দলের মুখপত্র গণশক্তি এর সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ঐ সময় পত্রিকাটি যাতে নিয়মিত বের হয় সেলক্ষ্যে তিনি কোন কোন সময় প্রেস কর্মচারীদের সাথে নিজেও কম্পোজিং এর কাজে নিয়োজিত হতে দ্বিধান্বিত হতেন না। উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, প্রিন্টিং এর কম্পোজিং তাঁর জানা ছিল। আজীবন সমাজতন্ত্রের রাজনীতিতে জেল, হুলিয়া সহ ব্যস্ত থাকা এই লোকটি নিজ জন্মস্থান ও স্থানীয় সমাজসেবা নিয়েও ভাবতেন। বালাগঞ্জ থানাধীন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতায় তার অবদান অবশ্যই স্বীকার করতে হবে। তাজপুর মহাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় এবং এর উন্নয়নে অর্থ সংগ্রহের জন্যে তিনি বিলেত পর্যন্ত গিয়েছিলেন। ১৯৭৪ সালে ভয়াবহ বন্যায় দেশের অপরাপর অংশের সাথে সিলেটও উপদ্রুত হলে ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তার লক্ষ্যে অর্থ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে তাঁর উদ্যোগে গঠিত কমিটির পরিচালনায় সিলেট স্টেডিয়ামে আয়োজন করা হয়েছিল চ্যারিটি ফুটবল খেলার। জননেতা আসাদ্দর আলীর চরিত্রের মধ্যে নানা ইতিবাচক বৈশিষ্ট্য থাকলেও তাঁর প্রধান পরিচয় হচ্ছে তিনি একজন আগাগোড়া রাজনীতিবিদ ছিলেন। ১৯৫২ সালে ঢাকায় ছাত্র ইউনিয়ন জন্মলাভের অব্যবহিত পূর্বে সিলেটে ছাত্র ইউনিয় নামের সংগঠন গড়ে তুলতে পুলিশী বাধার মুখেও যাঁরা অবদান রেখে গিয়েছেন তাঁদের অন্যতম হচ্ছেন আসাদ্দর আলী। ছাত্র ইউনিয়ন গঠন প্রক্রিয়ায় জড়িতদের মধ্যে অন্যান্য যাদের নাম জানা যায় তাঁরা হচ্ছেন এডভোকেট মনির উদ্দিন আহমদ, এডভোকেট জালাল উদ্দিন আহমদ খান, মরহুম ওয়ারিছ আলী ও মওলানা শামসুল হক প্রমুখ। ছাত্র ইউনিয়নের পর দীর্ঘ রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় যুবলীগ, আওয়ামী লীগ ও ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির রাজনীতিতে তিনি সক্রিয় ছিলেন পর্যায়ক্রমে। ১৯৫৩ সালে সোভিয়েত রাশিয়ার কমিউনিষ্ট পার্টির মহান নেতা কমরেড ষ্ট্যালিন মৃত্যুবরণ করেন এবং ১৯৫৬ সালে সোভিয়েত কমিউনিষ্ট পার্টির ২০তম কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। ঐ কংগ্রেসে সোভিয়েত পার্টি ‘শান্তিপূর্ণ পন্থায় সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব’ বলে বক্তব্য নিয়ে আসলে আন্তর্জাতিক কমিউনিষ্ট আন্দোলনে আদর্শিক বিতর্কের ঝড় উঠে। একদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন অপর দিকে চীন ও আলবেনিয়ার লেবারপার্টি। চীন-রাশিয়ার বিতর্কে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাম শিবিরও বিভক্ত হয়ে পড়ে। ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি দু’ভাগে ভাগ হয়ে ন্যাপ (ভাসানী) ও ন্যাপ (ওয়ালী) গঠিত হয়। কমরেড আসাদ্দর আলী চীনের বক্তব্যকে সঠিক হিসেবে গ্রহণ করে ন্যাপ (ভাসানী) তে অবস্থান নেন। একইভাবে পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিষ্ট পার্টির চীনপন্থি বলে পরিচিত অংশ গোপন অবস্থায় পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিষ্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেলিনবাদী) গঠন করেন এবং কমরেড আসাদ্দর আলী (এম.এল.) এর নেতৃত্বদানকারী কমরেড আব্দুল হক-মোহাম্মদ তোয়াহা’র সাথে একাত্ম থাকেন। ভারতের পশ্চিম বাংলার দার্জিলিং জেলার নকশালবাড়ী থানায় কমরেড চারু মজুমদারের নেতৃত্বে সংঘটিত ঐতিহাসিক কৃষক অভ্যুত্থানের প্রভাবে পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিষ্ট পার্টি (এম.এল.) এর সদস্যরা গণসংগঠনের রাজনীতি ছেড়ে চলে যাবার সিদ্ধান্ত নিলেও ১৯৭১ সালের পরেও কমরেড আসাদ্দর আলীকে ন্যাপ (ভাসানী) এর প্রকাশ্য রাজনীতিতে তৎপর থাকতে দেখা যায়। ১৯৭৩ সালে জাতীয় গণমুক্তি ইউনিয়ন (জাগমুই) নামে পৃথক একটি রাজনৈতিক দল গঠিত হয়। জাগমুই গঠনে মুখ্য ভূমিকা পালনকারীরা ছিলেন হাজী দানেশ, এনায়েৎ উল্লাহ খান, এডভোকেট খোন্দকার আব্দুল ওদুদ, সিরাজুল হোসেন খান এবং আসাদ্দর আলী। প্রকাশ্য রাজনীতিতে জনাব আসাদ্দর আলী ন্যাপ (ভাসানী) ও জাগমুই এর মধ্যে তৎপর থাকলেও পূর্ব পাকিস্তানের কমিনিস্টপার্টি (এম.এল.) থেকে বের হয়ে এসে মোহাম্মদ তোয়াহার নেতৃত্বে গঠিত বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল (এম.এল.) এর সাথে যুক্ত থাকেন। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত আওয়ামী শাসনামলে বিশেষ করে রক্ষীবাহিনী গঠিত হলে অন্যান্য বামপন্থী দলগুলো, বিশেষ করে চীনপন্থি নামে পরিচিত গোপন দল গুলোর উপর নেমে আসে চরম অবর্ণনীয় বর্বর নির্যাতন। সাম্যবাদী দল পরিণত হয় সরকারের টার্গেটে। রাজশাহীর তানোর নামক স্থানে একই দিনে হত্যা করা হয় সাম্যবাদী দলের ১১ জন বিপ্লবীকে। এই অবস্থায় ১৯৭৫ সালে খোন্দকার মোশতাক ও তৎপরবর্তীতে সামরিক জান্তা জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে ক্ষমতার পটপরিবর্তন ঘটলে এক পর্যায়ে সাম্যবাদী দল (এম.এল.) গোপন অবস্থান পরিত্যাগ করে প্রকাশ্য রাজনীতিতে আত্মপ্রকাশ করে এবং দলের নেতা মোহাম্মদ তোয়াহা আর ‘গলাকাটা রাজনীতি’ করবেন না বলে ১৯৭৯ সালের নির্বাচনের ভিতর দিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। সাম্যবাদী দলের অবস্থান পরিবর্তনের পর কমরেড আসাদ্দর আলী আর জাগমুই না করে প্রকাশ্যে সাম্যবাদী দলে তৎপর হন। উল্লেখ্য যে, সাম্যবাদী দলের আত্মপ্রকাশের ঘটনা, বিপ্লবী রাজনীতিকে ‘গলাকাটা রাজনীতি’ বলে আখ্যায়িত করা; মোহাম্মদ তোয়াহার ১৯৭৯ সালে জিয়াউর রহমানের পার্লামেন্টে শপথ গ্রহণ, জিয়া সরকারকে ‘জাতীয় সরকার’ হিসেবে মূল্যায়ণ, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারে যোগদান এবং এমনতর কার্যকলাপ পর্যবেক্ষক মহলে বাম রাজনীতি সম্পর্কে তাচ্ছিল্য ধারণার জন্ম দিলেও এবং দলীয় মন্ত্রীর সচেতন বক্তব্য শুনে আমজনতা তাকে পোপ এর চেয়ে অধিক ক্যাথলিক বলে মন্তব্য করা সত্ত্বেও ঐ প্রসঙ্গটির অবতারণা এখানে সমীচীন হবেনা। কমরেড আসাদ্দর আলী সাহেব তাঁর জীবনে অনেকবার গ্রেফতার বরণ করেছেন। আমাদের উপস্থিতিতে তিনি একবার গ্রেফতার হন। ১৯৭৬ সালে ১৭ নভেম্বর মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ইন্তিকাল করেন। ঐদিন রাত থেকেই সাম্যবাদী দলের নেতা হিসেবে কমরেড আসাদ্দর আলী, ন্যাপ (ভাসানী) নেতা লুৎফুর রহমান, পিপলস লীগ নেতা গাজী শফিক আহমদ সহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ সিলেটে পরদিন গায়েবানা জানাযা অনুষ্ঠান সহ একটি যৌথ কর্মসূচি গ্রহণ করেন এবং তদনুযায়ী মাইক যোগে প্রচার আরম্ভ করা হয়। দেশে সামরিক আইন চালু রয়েছে এই অজুহাতে পরদিন সকালে বন্দরবাজার এলাকায় হঠাৎ করে পুলিশ এসে কর্মসূচির প্রচার ও সংগঠিত করার কাজে তৎপর নেতা কর্মীদের উপর অতর্কিতে আক্রমন চালায়। একটি বিক্সায় করে মাইক যোগে প্রচার চালানোরত অবস্থায় দু’জন ন্যাপ সদস্য আহাদুস সামাদ ও মন্মথ রঞ্জন দে হারু কে জনৈক পুলিশের ডি.এস.পি. (এই পদটি বর্তমানে নেই) টেনে হেঁচড়ে নামিয়ে নির্যাতন চালান এবং জিন্দাবাজার পুরানলেনের মোঃ কানু ও বিলপারের মোঃ তাজিন নামক দু’জনকে পুলিশ গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। এই সাথে পুলিশ কমরেড আসাদ্দর আলীকেও গ্রেফতার করে। একদিকে মওলানা ভাসানীর মৃত্যুতে আমরা শোকাহত, অপরদিকে পুলিশী আক্রমণে আমরা হতভম্ব হয়ে পড়ি। দুপুরের দিকে আমরা সবাই বার লাইব্রেরিতে গমন করি। জেলা বারের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট গোলাম জ্বিলানী চৌধুরী ঘটনা শুনে তীব্র প্রতিবাদ ও পুলিশী আচরণে বিষ্ময় প্রকাশ করেন। তাঁর সাহসী পদক্ষেপে তৎক্ষণাৎ বার লাইব্রেরি হলে একটি শোক ও প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভা শেষে এডভোকেট গোলাম জ্বিলানী চৌধুরী, ন্যাপ নেতা লুৎফুর রহমান, রিফাকত হোসেন কমরেড, ইউনাইটেড পিপলস পার্টি নেতা এডভোকেট গিয়াস উদ্দিন আহমদ সহ আমরা সবাই কমরেড আসাদ্দর আলী এবং গ্রেফতারকৃত অন্যান্যদের মুক্তির দাবীতে বার লাইব্রেরী থেকে কতোয়ালী থানায় যাই। সামরিক আইন বহাল থাকায় ও মিছিল-সভার উপর নিষেধাজ্ঞা থাকায় আমরা কোন স্লোগান না দিয়ে নীরবে থানা প্রাঙ্গণে সমবেত হই ও দেখতে পাই যে, কতোয়ালী থানার তৎকালীন টিনশেড ভবনের সাধারণ হাজতীদের সাথে প্রবীণ রাজনীতিবিদ আসাদ্দর আলীকে দাঁড় করিয়ে তালাবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। পুলিশ কর্মকর্তাদের সাথে এডভোকেট গোলাম জিলানী চৌধুরী আলাপ করলেন। তারা বললেন উর্ধ্বতন মহলের নির্দেশে গ্রেফতার করা হয়েছে, তাদের করার কিছু নেই। অবশেষে চেষ্টা তদবীরের পর এস.পি.র কথানুযায়ী দিন পার করে সন্ধ্যায় মুক্ত হলে কমরেড আসাদ্দর আলী হাজত থেকে বের হয়ে এসে জানান যে, তিনি জীবনে অনেকবার গ্রেফতার বরণ করলেও ঐ বারের ন্যায় ইতঃপূর্বে আর কখনো এত বেশী অপমানিত হননি। এত জেল-নির্যাতনকে ভুলে গিয়েও কমরেড আসাদ্দর আলী ভুলে জাননি পারিবারিক দায়িত্বরোধকে। আসাদ্দর আলী সাহেব মৃত্যু শয্যায় থেকে তাঁর রাজনৈতিক সহকর্মী এডভোকেট মনির উদ্দিন আহমদ ও কদমতলী নিবাসী আব্দুল হামিদ কে ডেকে এনে তাঁর একমাত্র ভ্রাতুষ্পুত্র বাচ্চু’র বিয়ের ব্যবস্থা করেন। তাঁর ভাতিজির স্বামী ও পুত্র কন্যাদের নিয়েই একত্রে বসবাস করতেন কমরেড আসাদ্দর আলীর হৃদয়ের গভীরে। মৃত্যুর পূর্বে তিনি তাদের মধ্যে তাঁর সহায় সম্পত্তি বুঝিয়ে দিয়ে যান। ভ্রাতুষ্পুত্র, কন্যা, ভাতিজীর দিকের নাতি-নাতনীদের প্রতি কমরেড আসাদ্দর আলীর অকৃত্রিম স্নেহ মমতা ও দায়িত্ববোধ সর্বজন বিদিত। তাইতো তিনি তাদের প্রতি পালন করে গিয়েছেন সর্বময় দায়িত্ব। জানিনা তারা আজ কমরেড আসাদ্দর আলীর প্রতি কতটুকু দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। কমরেড আসাদ্দর আলীর ছোট্ট একটি শেষ ইচ্ছে ছিল। তিনি চেয়েছিলেন ধোপাদিঘীর পূর্বপারে সামান্য কিছু ভূমিতে একটি হল নির্মাণ করতে। যেখানে রাজনৈতিক দলগুলো বিনে ভাড়ায় সভা অনুষ্ঠান করবে। মৃত্যু শয্যায় থেকে তিনি বিষয়টি তৎকালীন পৌর চেয়ারম্যান এডভোকেট আ.ফ.ম. কামাল সহ আমাদের সকলকে বলে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেটি আজও অপূর্ণ রয়েছে। জননেতা আসাদ্দর আলীর নিজ বর্ণনা মতে তাঁর পিতৃদত্ত নাম হচ্ছে আছদ্দর আলী। বিভিন্ন সময় ঢাকা, সন্তোষ সহ বিভিন্ন স্থানে তিনি ও শ্রমিক নেতা আশিক উদ্দিন চৌধুরী এক সাথে বিভিন্ন সভায় সিলেট থেকে যেতেন ও মওলানা ভাসানীর সাথে দেখা হতো। মওলানা ভাসানী তাঁর নিজস্ব উচ্চারণে তাঁদের দু’জনকে ‘আসাদ্দার’ এবং ‘আশেক’ বলে সন্বোধন করতেন এবং এভাবেই এক সময়ে তাঁর নিজ নাম ‘আছদ্দর’ এর স্থলে ‘আসাদ্দর’ হয়ে যায়। ১৯৯০ সালের ২ ফেব্রুয়ারীতে কমরেড আসাদ্দর আলীর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে অবসান ঘটে ঘটনাবহুল বর্ণাঢ্য একটি জীবনের। ঐ দিন সন্ধ্যায় আমাদের সকলের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে বালাগঞ্জ তথা অধুনা ওসমানীনগর থানাধীন তাজপুরে নামাজে জানাযা শেষে সমাহিত করা হয় বর্ষীয়ান এই রাজনীতিবিদকে। ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক হয়ে তাজপুর অতিক্রম কালে আজও শ্রদ্ধা জানাই দেশপ্রেমিক সাম্যবাদী নেতা আসাদ্দর আলীকে, যেখানে তিনি শুয়ে আছেন নীরবে। লেখক : সাবেক সভাপতি, সিলেট জেলা আইনজীবি সমিতি।
কমরেড আসাদ্দর আলী,মৃত্যু নেই যাঁর : এমাদ উল্লাহ শহিদুল ইসলাম শাহিন
আসলেই চলমান ঐ প্রক্রিয়ার সমাপ্তি ঘটেছিল ১৯৯০ সালের ২ ফেব্রুয়ারী এ মহান নেতার সর্বশেষ নিঃশ্বাসের মধ্য দিয়েই। মৃত্যুর ২/৩ দিন পূর্বেও আত্মগোপনকারী বর্ষীয়ান কমিউনিষ্ট নেতা কমরেড দ্বিজেন সোম তাঁকে কাজীটুলা উপসড়কস্থ অস্থায়ী ভাড়া বাসায় দেখতে গেলে শয্যাশায়ী অবস্থায় তিনি মুষ্টিবদ্ধ হাত উপরে তুলে ধরে লাল সালাম জানিয়েছিলেন তাঁর ফেলে আসা জীবনের এ সহযোদ্ধাকে। জননেতা আসাদ্দর আলী ছিলেন নানামুখী প্রতিভার সমন্বিত বহিঃপ্রকাশ। সুদর্শন এই লোকটি কখনো নিজ গুণাবলীর প্রতি মোটেই যত্নবান ছিলেন না। যার ফলে তাঁর মধ্যে নিহিত কোন নির্দিষ্ট একটি চরিত্র বিশেষত্ব হয়ে প্রকাশ পেল না, তিনি রয়ে গেলেন মিশ্রিত এক বহু প্রতিভাধর ব্যক্তিত্বের বাহক হিসেবেই। যদিও রাজনীতিবিদই হচ্ছে তাঁর মুখ্য পরিচয়, তাঁর সমসাময়িক ও পরবর্তী প্রজন্ম সমূহের ঘনিষ্ঠজনদের অনেককেই শুনেছি তাঁকে ‘কবি সাহেব’ বলে সন্বোধন করতে। এদের একজন হচ্ছেন প্রাক্তন ছাত্র ইউনিয়ন ও পরবর্তীকালের ন্যাপ (মোঃ) ও বর্তমানে বিএনপি রাজনীতিতে সংশ্লিষ্ট জনাব গুলজার আহমদ। কমরেড আসাদ্দর আলী সাহেব একজন অসাধারণ কাব্যগুণের অধিকারী ছিলেন। তাঁর সৃষ্ট কবিতা-প্রবন্ধে রাজনৈতিক শ্রেণী চেতনাবোধ প্রকাশ পেত সূঁচের মতো, যদিও সেগুলোকে কখনোই রাজনৈতিক স্লোগান বা লিফলেট বলে মনে হতো না। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ জেনারেল এরশাদ দেশে সামরিক শাসন জারী করে বিচারপতি আব্দুস সাত্তারকে বঙ্গভবন থেকে বের করে দিলে আমরা অনেকেই সমবেত হই আসাদ্দর আলী সাহেবের ধোপাদিঘীরপারস্থ বাসভবনে। সেদিন তিনি আমাদেরকে নিয়ে বাহিরের চৌচালা ঘরে না বসে ভিতরের ঘরেই বসলেন এবং স্বভাবসুলভ ভাবে বিছানায় কাত হয়ে অর্ধশুয়া অবস্থায় আমাদের সাথে আলাপ করতে লাগলেন। মুহূর্তের মধ্যেই ফেলে আসা পাকিস্তানী রাজনীতির দীর্ঘ ইতিহাসের মর্মকথা অতি সংক্ষেপে বিবৃত করলেন। কিভাবে পাকিস্তানের গণপরিষদ ভেঙ্গে দিয়ে আমলা গোলাম মোহাম্মদের অগণতান্ত্রিক শাসন জারী করা হয়েছিল, কিভাবে গণপরিষদের সভাপতি তমিজ উদ্দিন খানের দায়েরকৃত সিন্ধু হাইকোর্টের মামলা পাকিস্তান সুপ্রীম কোর্টে নাকচ হয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে পাকিস্তানী রাজনীতিতে অসাংবিধানিক ধারা অনুপ্রবেশ করলো সবই তিনি বলে ফেললেন এবং বুঝিয়ে দিলেন এটি বাংলাদেশের দ্বিতীয় সামরিক শাসন হলেও এর ধারাবাহিকতা সেই পাকিস্তানী রাজনীতির ২৫ বছর থেকে হিসেব কষতে হবে এবং এও ব্যাখ্যা করে দেখালেন যে, আসলে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ প্রকৃত অর্থে স্বাধীন হয়নি। পাকিস্তান নামের একটি নয়া উপনিবেশিক রাষ্ট্র থেকে যুদ্ধ করে বাংলাদেশ নামের আরেকটি নয়া উপনিবেশিক রাষ্ট্র সৃষ্টি হয়েছে মাত্র, রাষ্ট্রের শ্রেণী চরিত্রের কোন পরিবর্তন হয়নি এবং ক্ষমতায় দলের পরিবর্তন হলেও শাসক শ্রেণীর উৎখাত হয়নি। যার কারণে পুরাতন ধারাবাহিকতা অব্যাহত রয়েছে। তিনি প্রাসঙ্গিকভাবে বাংলাদেশের প্রথম সরকারের আমলে বাকশাল নামক একদল গঠন করে অপরাপর দলগুলোকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা সহ রক্ষীবাহিনী গঠন ও ঐ বিশেষ বাহিনীর উপর নির্ভর করে দেশ শাসনকেও সামরিক শাসনের সাথে তুলনা করলেন। সবকিছুর মধ্যে তিনি আমাদেরকে উৎসাহ দিয়ে বললেন পাকিস্তান ও বাংলাদেশ দু’আমলের রাষ্ট্রীয় ফরমান জারীর মধ্য দিয়ে দেশের রাজনৈতিক চর্চাকে কখনো বন্ধ করা যায়নি, বন্ধ হয়নি। এদেশের প্রগতিশীলরা প্রতিকূল পরিবেশে সদা সর্বদা অতীব ঝুঁকি’র মধ্যেও তৎপর থেকেছেন। প্রয়োজনে কৌশলে, কখনো গোপনে, কখনো সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের ভিতর দিয়ে রাজনীতিকে সচল রাখতে হবে এবং এটা হচ্ছে বাম রাজনৈতিক কর্মীদের ঐতিহাসিক দায়িত্ব। কমরেড আসাদ্দর আলীর সেদিনের তাৎক্ষণিক বক্তব্য সমবেতদেরকে উজ্জীবিত করে দিক নির্দেশনা দিয়েছিল এবং সামরিক আইনে ভীত না হতে অনুপ্রাণিত করেছিল। আমরা সেদিন তাঁর কথায় বাংলাদেশ লেখক শিবির এর মাধ্যমে কর্মকান্ড যৌথ ভাবে চালিয়ে যেতে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম এবং যতদিন রাজনৈতিক তৎপরতা নিষিদ্ধ ছিল ততদিন প্রধানত লেখক শিবিরের মাধ্যমেই আমরা সক্রিয় ছিলাম। তখন লেখক শিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি ছিলেন ডঃ আহমদ শরীফ এবং সাধারণ সম্পাদক ছিলেন শাহরিয়ার কবির। একবার মহান মে দিবস উপলক্ষে লেখক শিবিরের একটি প্রকাশনায় একটি লেখা দেয়ার জন্যে কমরেড আসাদ্দর আলীকে অনুরোধ করলে তিনি অনুপম একটি কবিতা লিখে দেন। যার নাম ছিল ‘লাল পতাকার জন্মদিনে’। মৃত্যু শয্যায় থেকে এক পর্যায়ে তিনি তাঁর নিজ কবরের এপিটাফ রচনা করে যান, সেটি হচ্ছে, ‘জীবনের তরে লড়ে যারা মরে, মৃত্যু নাই তাঁর’। কমরেড আসাদ্দর আলীর লেখক সত্ত্বা নিয়ে আরেকটি কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন। সামরিক শাসন আমলেই ২১ ফেব্রুয়ারীতে আমরা ‘ফাগুন’ নামে একটি পত্রিকা বের করি। পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলাম আমি নিজেই। সেখানে আসাদ্দর ভাই সিলেটের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস প্রসঙ্গে একটি বিরল মূল্যবান প্রবন্ধ লিখেছিলেন। বিভিন্ন পত্রিকায় গ্রন্থ সমালোচনা কলামে ঐ স্মরণিকার সমালোচনা করতে গিয়ে ঐ প্রবন্ধটির বহুবিধ প্রশংসা করেছিলেন অনেকেই। যেখানে লুপ্ত গোবিন্দ চরণ পার্কে ভাষা আন্দোলনকারীদের সমাবেশে মুসলিম লীগের গুন্ডাবাহিনীর আক্রমণের চাক্ষুষ বর্ণনাসহ হযরত শাহজালাল (রঃ) দরগাহ শরীফের তৎকালীন মতোয়াল্লী সরেকওম এ.জেড. আব্দুল্লাহ সাহেবের ভাষা আন্দোলনে পৃষ্ঠাপোষকতা প্রভৃতি বিবিধ বিষয় জীবন্তভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন তিনি। আমার কাছ থেকে ফাগুন পত্রিকাটির সংরক্ষিত সংখ্যাটি সাম্যবাদী দলের নেতা শ্রদ্ধেয় ধীরেন সিংহ নিয়ে যাওয়ায় এবং সেটি তিনি আর খোঁজে না পাওয়ায় ঐ গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাসময় প্রবন্ধটি চিরতরে হারিয়ে গেল। আমার চলার পথে অনেক বামপন্থী ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্যে যাবার সুযোগ হয়েছে, এদের মধ্যে কমরেড আব্দুল হক, অজয় ভট্টাচার্য, তোয়াহা, মতিন, আলাউদ্দিন, হাজী দানেশ, দেবেন শিকদার, আবুল বাশার প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। এদের অনেককেই হোমিওপ্যাথিক ঔষধ সেবন করতে দেখেছি। এদেশের কমিউনিষ্ট আন্দোলনের প্রবীণ ব্যক্তিদের অধিকাংশেরই রাজনীতির হাতেকড়ি হয়েছিল অগ্নিযুগের সংগঠন যুগান্তর এবং অনুশীলন এর ভিতর দিয়ে। যুগান্তর এবং অনুশীলন সংগঠনে কঠিন সংযম, অধ্যবসায় এর সাথে ভারতীয় সমাজের আদি বিষয়াদির চর্চা হতো। হোমিওপ্যাথি উপমহাদেশের আদিভিত্তিক না হলেও যুগান্তর-অনুশীলন সংগঠনে এর প্রচলন লক্ষ্য করা যায়। সেই ধারায় কমরেড আসাদ্দর আলীও ব্যতিক্রম ছিলেন না। তিনি ছিলেন একজন হোমিও চিকিৎসক। তাঁর ঘরে সব সময়ই কিছু হোমিওপ্যাথি ঔষধ থাকতো এবং লোকজনকে বিশেষ করে গরীব রিক্সাচালক, ফেরিওয়ালা ও মেহনতী মানুষকে তিনি বিনা পয়সায় হোমিও চিকিৎসা প্রদান করতেন। অনেককেই তাঁর কাছ থেকে হোমিও চিকিৎসা গ্রহণ করতে দেখেছি, আমি নিজেও দু’একবার কমরেড আসাদ্দর আলীর কাছ থেকে হোমিওপ্যাথি ঔষধ গ্রহণ করেছিলাম। সাংবাদিকতা, প্রেস ও প্রিন্টিং এর সাথেও জড়িত ছিলেন তিনি। আমরা শুনেছি একসময় সিলেট প্রিন্টার্স সিলেট শহরের নাইওরপুলে অবস্থিত ছিল এবং ঐ প্রিন্টার্স-কে কেন্দ্র করে পত্রিকা প্রকাশ ও প্রিটিং কাজে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন শ্রদ্ধেয় আসাদ্দর আলী সাহেব। জীবনের শেষাংশে তিনি বেশ কিছু দিন ঢাকায় অবস্থান করেন। তখন তিনি সাম্যবাদী দলের মুখপত্র গণশক্তি এর সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ঐ সময় পত্রিকাটি যাতে নিয়মিত বের হয় সেলক্ষ্যে তিনি কোন কোন সময় প্রেস কর্মচারীদের সাথে নিজেও কম্পোজিং এর কাজে নিয়োজিত হতে দ্বিধান্বিত হতেন না। উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, প্রিন্টিং এর কম্পোজিং তাঁর জানা ছিল। আজীবন সমাজতন্ত্রের রাজনীতিতে জেল, হুলিয়া সহ ব্যস্ত থাকা এই লোকটি নিজ জন্মস্থান ও স্থানীয় সমাজসেবা নিয়েও ভাবতেন। বালাগঞ্জ থানাধীন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতায় তার অবদান অবশ্যই স্বীকার করতে হবে। তাজপুর মহাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় এবং এর উন্নয়নে অর্থ সংগ্রহের জন্যে তিনি বিলেত পর্যন্ত গিয়েছিলেন। ১৯৭৪ সালে ভয়াবহ বন্যায় দেশের অপরাপর অংশের সাথে সিলেটও উপদ্রুত হলে ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তার লক্ষ্যে অর্থ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে তাঁর উদ্যোগে গঠিত কমিটির পরিচালনায় সিলেট স্টেডিয়ামে আয়োজন করা হয়েছিল চ্যারিটি ফুটবল খেলার। জননেতা আসাদ্দর আলীর চরিত্রের মধ্যে নানা ইতিবাচক বৈশিষ্ট্য থাকলেও তাঁর প্রধান পরিচয় হচ্ছে তিনি একজন আগাগোড়া রাজনীতিবিদ ছিলেন। ১৯৫২ সালে ঢাকায় ছাত্র ইউনিয়ন জন্মলাভের অব্যবহিত পূর্বে সিলেটে ছাত্র ইউনিয় নামের সংগঠন গড়ে তুলতে পুলিশী বাধার মুখেও যাঁরা অবদান রেখে গিয়েছেন তাঁদের অন্যতম হচ্ছেন আসাদ্দর আলী। ছাত্র ইউনিয়ন গঠন প্রক্রিয়ায় জড়িতদের মধ্যে অন্যান্য যাদের নাম জানা যায় তাঁরা হচ্ছেন এডভোকেট মনির উদ্দিন আহমদ, এডভোকেট জালাল উদ্দিন আহমদ খান, মরহুম ওয়ারিছ আলী ও মওলানা শামসুল হক প্রমুখ। ছাত্র ইউনিয়নের পর দীর্ঘ রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় যুবলীগ, আওয়ামী লীগ ও ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির রাজনীতিতে তিনি সক্রিয় ছিলেন পর্যায়ক্রমে। ১৯৫৩ সালে সোভিয়েত রাশিয়ার কমিউনিষ্ট পার্টির মহান নেতা কমরেড ষ্ট্যালিন মৃত্যুবরণ করেন এবং ১৯৫৬ সালে সোভিয়েত কমিউনিষ্ট পার্টির ২০তম কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। ঐ কংগ্রেসে সোভিয়েত পার্টি ‘শান্তিপূর্ণ পন্থায় সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব’ বলে বক্তব্য নিয়ে আসলে আন্তর্জাতিক কমিউনিষ্ট আন্দোলনে আদর্শিক বিতর্কের ঝড় উঠে। একদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন অপর দিকে চীন ও আলবেনিয়ার লেবারপার্টি। চীন-রাশিয়ার বিতর্কে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাম শিবিরও বিভক্ত হয়ে পড়ে। ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি দু’ভাগে ভাগ হয়ে ন্যাপ (ভাসানী) ও ন্যাপ (ওয়ালী) গঠিত হয়। কমরেড আসাদ্দর আলী চীনের বক্তব্যকে সঠিক হিসেবে গ্রহণ করে ন্যাপ (ভাসানী) তে অবস্থান নেন। একইভাবে পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিষ্ট পার্টির চীনপন্থি বলে পরিচিত অংশ গোপন অবস্থায় পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিষ্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেলিনবাদী) গঠন করেন এবং কমরেড আসাদ্দর আলী (এম.এল.) এর নেতৃত্বদানকারী কমরেড আব্দুল হক-মোহাম্মদ তোয়াহা’র সাথে একাত্ম থাকেন। ভারতের পশ্চিম বাংলার দার্জিলিং জেলার নকশালবাড়ী থানায় কমরেড চারু মজুমদারের নেতৃত্বে সংঘটিত ঐতিহাসিক কৃষক অভ্যুত্থানের প্রভাবে পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিষ্ট পার্টি (এম.এল.) এর সদস্যরা গণসংগঠনের রাজনীতি ছেড়ে চলে যাবার সিদ্ধান্ত নিলেও ১৯৭১ সালের পরেও কমরেড আসাদ্দর আলীকে ন্যাপ (ভাসানী) এর প্রকাশ্য রাজনীতিতে তৎপর থাকতে দেখা যায়। ১৯৭৩ সালে জাতীয় গণমুক্তি ইউনিয়ন (জাগমুই) নামে পৃথক একটি রাজনৈতিক দল গঠিত হয়। জাগমুই গঠনে মুখ্য ভূমিকা পালনকারীরা ছিলেন হাজী দানেশ, এনায়েৎ উল্লাহ খান, এডভোকেট খোন্দকার আব্দুল ওদুদ, সিরাজুল হোসেন খান এবং আসাদ্দর আলী। প্রকাশ্য রাজনীতিতে জনাব আসাদ্দর আলী ন্যাপ (ভাসানী) ও জাগমুই এর মধ্যে তৎপর থাকলেও পূর্ব পাকিস্তানের কমিনিস্টপার্টি (এম.এল.) থেকে বের হয়ে এসে মোহাম্মদ তোয়াহার নেতৃত্বে গঠিত বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল (এম.এল.) এর সাথে যুক্ত থাকেন। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত আওয়ামী শাসনামলে বিশেষ করে রক্ষীবাহিনী গঠিত হলে অন্যান্য বামপন্থী দলগুলো, বিশেষ করে চীনপন্থি নামে পরিচিত গোপন দল গুলোর উপর নেমে আসে চরম অবর্ণনীয় বর্বর নির্যাতন। সাম্যবাদী দল পরিণত হয় সরকারের টার্গেটে। রাজশাহীর তানোর নামক স্থানে একই দিনে হত্যা করা হয় সাম্যবাদী দলের ১১ জন বিপ্লবীকে। এই অবস্থায় ১৯৭৫ সালে খোন্দকার মোশতাক ও তৎপরবর্তীতে সামরিক জান্তা জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে ক্ষমতার পটপরিবর্তন ঘটলে এক পর্যায়ে সাম্যবাদী দল (এম.এল.) গোপন অবস্থান পরিত্যাগ করে প্রকাশ্য রাজনীতিতে আত্মপ্রকাশ করে এবং দলের নেতা মোহাম্মদ তোয়াহা আর ‘গলাকাটা রাজনীতি’ করবেন না বলে ১৯৭৯ সালের নির্বাচনের ভিতর দিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। সাম্যবাদী দলের অবস্থান পরিবর্তনের পর কমরেড আসাদ্দর আলী আর জাগমুই না করে প্রকাশ্যে সাম্যবাদী দলে তৎপর হন। উল্লেখ্য যে, সাম্যবাদী দলের আত্মপ্রকাশের ঘটনা, বিপ্লবী রাজনীতিকে ‘গলাকাটা রাজনীতি’ বলে আখ্যায়িত করা; মোহাম্মদ তোয়াহার ১৯৭৯ সালে জিয়াউর রহমানের পার্লামেন্টে শপথ গ্রহণ, জিয়া সরকারকে ‘জাতীয় সরকার’ হিসেবে মূল্যায়ণ, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারে যোগদান এবং এমনতর কার্যকলাপ পর্যবেক্ষক মহলে বাম রাজনীতি সম্পর্কে তাচ্ছিল্য ধারণার জন্ম দিলেও এবং দলীয় মন্ত্রীর সচেতন বক্তব্য শুনে আমজনতা তাকে পোপ এর চেয়ে অধিক ক্যাথলিক বলে মন্তব্য করা সত্ত্বেও ঐ প্রসঙ্গটির অবতারণা এখানে সমীচীন হবেনা। কমরেড আসাদ্দর আলী সাহেব তাঁর জীবনে অনেকবার গ্রেফতার বরণ করেছেন। আমাদের উপস্থিতিতে তিনি একবার গ্রেফতার হন। ১৯৭৬ সালে ১৭ নভেম্বর মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ইন্তিকাল করেন। ঐদিন রাত থেকেই সাম্যবাদী দলের নেতা হিসেবে কমরেড আসাদ্দর আলী, ন্যাপ (ভাসানী) নেতা লুৎফুর রহমান, পিপলস লীগ নেতা গাজী শফিক আহমদ সহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ সিলেটে পরদিন গায়েবানা জানাযা অনুষ্ঠান সহ একটি যৌথ কর্মসূচি গ্রহণ করেন এবং তদনুযায়ী মাইক যোগে প্রচার আরম্ভ করা হয়। দেশে সামরিক আইন চালু রয়েছে এই অজুহাতে পরদিন সকালে বন্দরবাজার এলাকায় হঠাৎ করে পুলিশ এসে কর্মসূচির প্রচার ও সংগঠিত করার কাজে তৎপর নেতা কর্মীদের উপর অতর্কিতে আক্রমন চালায়। একটি বিক্সায় করে মাইক যোগে প্রচার চালানোরত অবস্থায় দু’জন ন্যাপ সদস্য আহাদুস সামাদ ও মন্মথ রঞ্জন দে হারু কে জনৈক পুলিশের ডি.এস.পি. (এই পদটি বর্তমানে নেই) টেনে হেঁচড়ে নামিয়ে নির্যাতন চালান এবং জিন্দাবাজার পুরানলেনের মোঃ কানু ও বিলপারের মোঃ তাজিন নামক দু’জনকে পুলিশ গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। এই সাথে পুলিশ কমরেড আসাদ্দর আলীকেও গ্রেফতার করে। একদিকে মওলানা ভাসানীর মৃত্যুতে আমরা শোকাহত, অপরদিকে পুলিশী আক্রমণে আমরা হতভম্ব হয়ে পড়ি। দুপুরের দিকে আমরা সবাই বার লাইব্রেরিতে গমন করি। জেলা বারের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট গোলাম জ্বিলানী চৌধুরী ঘটনা শুনে তীব্র প্রতিবাদ ও পুলিশী আচরণে বিষ্ময় প্রকাশ করেন। তাঁর সাহসী পদক্ষেপে তৎক্ষণাৎ বার লাইব্রেরি হলে একটি শোক ও প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভা শেষে এডভোকেট গোলাম জ্বিলানী চৌধুরী, ন্যাপ নেতা লুৎফুর রহমান, রিফাকত হোসেন কমরেড, ইউনাইটেড পিপলস পার্টি নেতা এডভোকেট গিয়াস উদ্দিন আহমদ সহ আমরা সবাই কমরেড আসাদ্দর আলী এবং গ্রেফতারকৃত অন্যান্যদের মুক্তির দাবীতে বার লাইব্রেরী থেকে কতোয়ালী থানায় যাই। সামরিক আইন বহাল থাকায় ও মিছিল-সভার উপর নিষেধাজ্ঞা থাকায় আমরা কোন স্লোগান না দিয়ে নীরবে থানা প্রাঙ্গণে সমবেত হই ও দেখতে পাই যে, কতোয়ালী থানার তৎকালীন টিনশেড ভবনের সাধারণ হাজতীদের সাথে প্রবীণ রাজনীতিবিদ আসাদ্দর আলীকে দাঁড় করিয়ে তালাবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। পুলিশ কর্মকর্তাদের সাথে এডভোকেট গোলাম জিলানী চৌধুরী আলাপ করলেন। তারা বললেন উর্ধ্বতন মহলের নির্দেশে গ্রেফতার করা হয়েছে, তাদের করার কিছু নেই। অবশেষে চেষ্টা তদবীরের পর এস.পি.র কথানুযায়ী দিন পার করে সন্ধ্যায় মুক্ত হলে কমরেড আসাদ্দর আলী হাজত থেকে বের হয়ে এসে জানান যে, তিনি জীবনে অনেকবার গ্রেফতার বরণ করলেও ঐ বারের ন্যায় ইতঃপূর্বে আর কখনো এত বেশী অপমানিত হননি। এত জেল-নির্যাতনকে ভুলে গিয়েও কমরেড আসাদ্দর আলী ভুলে জাননি পারিবারিক দায়িত্বরোধকে। আসাদ্দর আলী সাহেব মৃত্যু শয্যায় থেকে তাঁর রাজনৈতিক সহকর্মী এডভোকেট মনির উদ্দিন আহমদ ও কদমতলী নিবাসী আব্দুল হামিদ কে ডেকে এনে তাঁর একমাত্র ভ্রাতুষ্পুত্র বাচ্চু’র বিয়ের ব্যবস্থা করেন। তাঁর ভাতিজির স্বামী ও পুত্র কন্যাদের নিয়েই একত্রে বসবাস করতেন কমরেড আসাদ্দর আলীর হৃদয়ের গভীরে। মৃত্যুর পূর্বে তিনি তাদের মধ্যে তাঁর সহায় সম্পত্তি বুঝিয়ে দিয়ে যান। ভ্রাতুষ্পুত্র, কন্যা, ভাতিজীর দিকের নাতি-নাতনীদের প্রতি কমরেড আসাদ্দর আলীর অকৃত্রিম স্নেহ মমতা ও দায়িত্ববোধ সর্বজন বিদিত। তাইতো তিনি তাদের প্রতি পালন করে গিয়েছেন সর্বময় দায়িত্ব। জানিনা তারা আজ কমরেড আসাদ্দর আলীর প্রতি কতটুকু দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। কমরেড আসাদ্দর আলীর ছোট্ট একটি শেষ ইচ্ছে ছিল। তিনি চেয়েছিলেন ধোপাদিঘীর পূর্বপারে সামান্য কিছু ভূমিতে একটি হল নির্মাণ করতে। যেখানে রাজনৈতিক দলগুলো বিনে ভাড়ায় সভা অনুষ্ঠান করবে। মৃত্যু শয্যায় থেকে তিনি বিষয়টি তৎকালীন পৌর চেয়ারম্যান এডভোকেট আ.ফ.ম. কামাল সহ আমাদের সকলকে বলে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেটি আজও অপূর্ণ রয়েছে। জননেতা আসাদ্দর আলীর নিজ বর্ণনা মতে তাঁর পিতৃদত্ত নাম হচ্ছে আছদ্দর আলী। বিভিন্ন সময় ঢাকা, সন্তোষ সহ বিভিন্ন স্থানে তিনি ও শ্রমিক নেতা আশিক উদ্দিন চৌধুরী এক সাথে বিভিন্ন সভায় সিলেট থেকে যেতেন ও মওলানা ভাসানীর সাথে দেখা হতো। মওলানা ভাসানী তাঁর নিজস্ব উচ্চারণে তাঁদের দু’জনকে ‘আসাদ্দার’ এবং ‘আশেক’ বলে সন্বোধন করতেন এবং এভাবেই এক সময়ে তাঁর নিজ নাম ‘আছদ্দর’ এর স্থলে ‘আসাদ্দর’ হয়ে যায়। ১৯৯০ সালের ২ ফেব্রুয়ারীতে কমরেড আসাদ্দর আলীর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে অবসান ঘটে ঘটনাবহুল বর্ণাঢ্য একটি জীবনের। ঐ দিন সন্ধ্যায় আমাদের সকলের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে বালাগঞ্জ তথা অধুনা ওসমানীনগর থানাধীন তাজপুরে নামাজে জানাযা শেষে সমাহিত করা হয় বর্ষীয়ান এই রাজনীতিবিদকে। ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক হয়ে তাজপুর অতিক্রম কালে আজও শ্রদ্ধা জানাই দেশপ্রেমিক সাম্যবাদী নেতা আসাদ্দর আলীকে, যেখানে তিনি শুয়ে আছেন নীরবে। লেখক : সাবেক সভাপতি, সিলেট জেলা আইনজীবি সমিতি।
Post a Comment
0 comments
কমরেড আসাদ্দর আলী বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় নাম।তিনি সারাজীবন মেহনতী মানুষের কল্যানে কাজ করে গেছেন।১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে তার অবিস্মরণীয় অবদান ছিল।তিনি কমিনিষ্ট আন্দোলনের পথিকৃত এবং বাংলাদেশের সাম্যবাদী দলের সাবেক সভাপতি ছিলেন।গণ মানুষের নেতা কমরেড আসাদ্দর আলীর স্বরনে একটি ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা মাত্র।সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ।