সিলেট জেলার বালাগঞ্জ থানার তাজপুরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন- গত শতাব্দীর প্রথমার্ধে। তাঁর জন্মের পরেই তিনি দেখেছেন দেশ পরাধীন। বৃটিশ বেনিয়া শাসক গোষ্ঠি এদেশটি দখল করে রেখেছে। এদেশবাসী নিজেদের দেশেই যেন পরবাসী। তাঁর কৈশোর ও তারুণ্যেও সময়ে এদেশে বৃটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের উত্তল তরঙ্গে ভেসে চলেছে। সা¤্রাজ্যবাদী বৃটিশকে এদেশ থেকে বিতাড়ন করার জন্য সারা উপমহাদেশে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের কাফেলা দিনে দিনে শক্তিশালী হচ্ছে, তখন কিশোর আসাদ্দর আলীও এক সময়ে শরীক হলেন। ‘বৃটিশ সা¤্রাজ্যবাদ নিপাত যাক’, ‘ভারত বর্ষের স্বাধীনতা চাই, ‘বন্দে মাতরমম্ব এসব শ্লোগানে যখন ভারতবর্ষের আকাশ-বাতাস মুখরিত, তখন তার কন্ঠেও একই শ্লোগান। বৃটিশ সা¤্রাজ্যবাদ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রাম করার মাধ্যমেই রাজনীতিতে তার হাতে খড়ি।
বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থায় সামন্তবাদী সমাজ কাঠামো ছিল এদেশে প্রতিষ্ঠিত। কৃষি ভিত্তিক এই দেশে বৃটিশ শাসনের মূল শক্তি ছিল সামন্তবাদী জমিদার মহাজন চক্র। যদিও সতের শতকে ইউরোপে শিল্পবিপ্লবের পর পুজিবাদী অর্থনীতির যাত্রা শুরু হয়েছে, সেই শিল্প বিপ্লবের ছিটেফোটা ঢেউ এদেশে এসে লেগেছে- কিন্তু শিল্প কারখানা প্রতিষ্ঠিত হলেও তা অর্থনীতিতে তেমন প্রভাব সৃষ্টি করতে পারেনি। তবে এই শিল্প কারখানা প্রতিষ্ঠার পথ ধরে দেশে কিছু একচেটিয়া পুঁজি গড়ে উঠছিল- শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোও ছিল শ্রমিকদের শোষণের হাতিয়ার। যারা কৃষিতে জীবনযাপন করে, সেই কৃষক তখন জমির মালিক ছিলনা, জমির মালিক ছিলো জমিদার গোষ্ঠি। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুলের ভাষায় জমিতে যাদের চরণ ঠেকেনা, তারাই জমির মালিক-জমিদার। অথচ যারা সারাজীবন জমিতে শ্রম, ঘাম দিয়ে ফসল ফলান, তারা জমির মালিক নন। এই অন্যায় ব্যবস্থা চলতে দিলে বৃটিশ চলে গেলেও মানুষের মুক্তি আসবে না। ঠিক কারখানার শ্রমিকদেরকেও উৎপাদন যন্ত্রে যদি জনগণের মালিকানা প্রতিষ্ঠা করা না যায়, তা হলে শোষণ অব্যাহত থাকবে, শোষকের হাতে থাকবে রাষ্ট্র ব্যবস্থা, মানুষের জীবনের কোন পরিবর্তন হবে না। বিদ্যমান সমাজ ব্যবস্থা নিয়ে যদি স্বাধীনতা আসেও বৃটিশরা যদি এদেশ ছেড়ে চলে যায়, তা হলেও সাধারণ মানুষ তথা কৃষক-শ্রমিক-মেহনতী মানুষের জীবনে কোন পরিবর্তন হবে না। তারা আগের মতোই শোষিত হতে থাকবে।
অতএব এ অবস্থায় কি করতে হবে বৃটিশদের যেমনি তাড়াতে হবে, আবার সমাজটাকেও পাল্টাতে হবে। সমাজ পাল্টিয়ে মানুষের মুক্তি দিতে পারে সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা। এই দর্শন বা চেতনা থেকে একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী আসাদ্দর আলী পরিণত হনে একজন সমাজতন্ত্রী আসাদ্দর আলীতে। একজন জাতীয়তাবাদী আস্তে আস্তে নিজ অভিজ্ঞতার সড়কে হাটতে হাটতে একজন আন্তর্জাতিকতাবাদীতে রুপান্তরিত হলেন।
১৯৪৭ সালে বৃটিশ এদেশ থেকে চলে গেলো। কিন্তু ভাগ করে দিয়ে গেলো ভারত উপমহাদেশ। ধর্মের ভিত্তিতে সৃষ্টি হলো দুটি রাষ্ট্র পাকিস্তান ও ভারত। মুসলমানদের জন্য প্রতিষ্ঠিত হলো পাকিস্তান। স্বাধীনতা এলো বটে, কিন্তু নিয়ে এলো নূতন বিপদ। সাম্প্রাদায়িকতা। স্বাধীনতার অব্যবহিত আগে আর পরে সংঘটিত হলো ন্যাক্কারজনক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। দাঙ্গা পীড়িত হলো বাংলা। আসাদ্দর আলীর মতো প্রগতিশীল চিন্তা চেতনার অধিকারীরা তখন উপলব্ধি করলেন, তারা সমাজ পাল্টানোর যে স্বপ্ন দেখছিলেন, স্বাধীন দেশে মুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠায় তারা অনুকূল পরিবেশ লাভের যে ধারণা পোষণ করতেন, সাম্প্রদায়িকতা বা ধর্মীয় ভেদ বুদ্ধির আড়ালে তাকে প্রতিহত করার ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে শোষক শ্রেণী। তাই এদেশে একটি অসাম্প্রাদায়িক পরিবেশ তৈরী করতে হবে। সাম্প্রাদায়িকতাকে প্রতিহত করতে হবে আর সে জন্য সিলেটে দেশ-বিভাগ পরবর্তীকালে সাম্প্রদায়িকতা প্রতিহত করাকে প্রধান কর্তব্য নির্ধারণ করে যে সব চিন্তাশীল রাজনীতিক কর্মী এগিয়ে এলেন- তার মধ্যে অন্যতম প্রধান কর্মী ছিলেন কমরেড আসাদ্দর আলী। তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে সিলেটে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ এড়ানো সম্ভব হয়েছিলো। পরবর্তীকালে ভাষা আন্দোলনের সময়ের একই চেতনা থেকে নিরলস কাজ করে গেছেন গোটা সিলেট জেলায়। ১৯৫১ সালে এদেশে প্রথম অসাম্প্রদায়িক ছাত্র সংগঠন সিলেট জেলা ছাত্র ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও আসাদ্দর আলী ছিলেন একজন প্রথম কাতারের সৈনিক। পূর্ব পাকিস্তানে একটি অসাম্প্রদায়িক যুব সংগঠন যুবলীগ প্রতিষ্ঠা এবং এই সংগঠনটিকে সিলেটে ব্যাপক ভিত্তি দানের ক্ষেত্রেও তিনি ছিলেন অন্যতম পুরোধা।
১৯৫৭ সালে মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ ও একচেটিয়া পুঁজিবাদ বিরোধী রাজনৈতিক দল হিসেবে ন্যাপ আত্ম প্রকাশ করলে আসাদ্দর আলী তার একজন বলিষ্ঠ নেতা হিসেবে সিলেটে এই সংগঠনটিকে ব্যাপ্তি ঘটাতে কাজ করতে থাকেন। একই সাথে কৃষক সমিতি সংগঠনকরা, শ্রমিক সংগঠনের কাজের ব্যাপৃত ছিলেন। যদিও তিনি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, কৃষক সমিতি ইত্যাদি সংগঠনের সাথে প্রকাশ্যে কাজ করেছেন, কিন্তু তিনি ছিলেন মূলঃ কমিউনিস্ট পার্টির একজন নিবেদিত কর্মী।
গত শতাব্দীর ষাটের দশকে এই উপমহাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলন চীন, সোভিয়েত মতবাদ দ্বন্দ্বে দ্বিধা বিভক্ত হয়ে পড়ে। তখন তিনি চীনপন্থি বলে পরিচিত অংশের সাথে চলে যান। সে সময় তিনি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সিলেট জেলার প্রধান নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন। একই সাথে তিনি শ্রমিক ইউনিয়ন এবং তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান শ্রমিক ইউনিয়নের সাথেও জড়িত ছিলেন। এদিকে কমিউনিস্ট পার্টি প্রথমে চীনপন্থি হিসেবে বিভক্ত হলেও পরবর্তীতে চীনপন্থি অংশটি কয়েকটি ভাগে বিভক্ত হলো। তিনি মো. তোয়াহার নেতৃত্বাধীন অংশের সাথে ছিলেন।
১৯৭১ সালে চীনপন্থি হিসেবে পরিচিত কমিউনিস্ট পার্টির বিভিন্ন আংশ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করে আবার কয়েকটি অংশ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান নেয়। কমরেড আসাদ্দর আলী মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান নেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর আসাদ্দর আলী মোঃ তোয়াহার নেতৃত্বাধীন সাম্যবাদী দলে কেন্দ্রীয় নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন এবং এই দলের সাধারন সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি তাদের দলের মুখপত্রেরও সম্পাদক ছিলেন। মৃত্যুকাল পর্যন্ত তিনি সাম্যবাদী দলের নেতা ছিলেন।
কমরেড আসাদ্দর আলীর সাথে আমার পরিচয় ছিলো সেই ১৯৬৫ সাল থেকে। ১৯৬৬ সালে সিলেট আইয়ুবখানের ওপর জুতো ছুড়ে মারার ঘটনার পর গ্রেফতার হন তিনি। এর পূর্ব পর্যন্ত প্রায় প্রতিদিনই তার সাথে দেখা হতো। আমি তখন একজন তরুণ ছাত্র কর্মী। তাঁর সাথে পরিচয়ের সুবাদে আমি তাকে অত্যন্ত ঘনিষ্টভাবে দেখার সুযোগ পেয়েছি। নাইওরপুলে সিলেট প্রিন্টার্স নামে একটি প্রেস ছিলো তার। ছাত্র ইউনিয়ন তখন অবিভক্ত। এই প্রেসই ছিলো ছাত্র ইউনিয়নের অঘোষিত কার্যালয়। তিনি প্রতিটি ছাত্র-কর্মীর সাথে অত্যন্ত আন্তরিকভাবে মিশতেন। প্রত্যেকের ব্যক্তিগত খোঁজ খবর নিতেন এবং তাদের সাথে রাজনীতির আত্মিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করতেন।
ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন অত্যন্ত সাদাসিধে প্রকৃতির লোক। লেখাপড়া করতেন অবিরত। আর রাজনৈতিক তত্ত্বের দিক থেকে তিনি ছিলেন একজন পন্ডিত। রাজনীতির পাশাপাশি তিনি সাহিত্য চর্চাও করতেন। তিনি কবিতা লিখতেন। তাকে আমরা ‘কবি সাহেব’বলে ডাকতাম। যদিও তাঁর কবিতা প্রকাশিত হতো না, কিন্তু তার কবিতা লেখার খাতা ছিলো কবিতায় পরিপূর্ণ।
আইয়ুব খানের পতনের পূর্বে তিনি কারাগার থেকে বের হওয়ার পর চীনপন্থি রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত থাকার ফলে তাঁর সাথে আমার যোগাযোগ কমে গেলেও স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে তার সাথে আমার যোগাযোগ আবার ঘনিষ্ট হয়ে ওঠে এবং তার মৃত্যুকাল পর্যন্ত অব্যাহত ছিলো।
এ প্রসঙ্গে আমার একটি দিনের কথা বিশেষভাবে মনে পড়ছে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানী সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণের পর আমরা যারা ভারতের করিমগঞ্জে ছিলাম, তারা একটি গাড়ীতে করে সিলেট শহরে আসি। অন্যদিকে শিলং থেকে পীর হবিবুর রহমান, বরুণ রায় প্রমুখ নেতারা একটি জীপে করে আসেন। আমরা কবি দিলওয়ারের বাড়ীতে গাড়ী রেখে নৌকা যোগে সুরমা নদী পার হই। ক্বীন ব্রিজ পাকিস্তানী সেনারা পিছু হটার সময় ভেঙ্গে দিয়েছিলো। আমরা নৌকাযোগে পার হয়ে যখন এপারে ক্বীন ব্রিজের গোড়ায় আসি, তখন আসাদ্দর আলী সাহেব আমাদের বরণ করেছিলেন। প্রায় একই সময়ে পীর সাহেবরাও এসে পৌঁছান। তারপর সে কি কান্না। তার সাথে ছিলেন লুৎফুর রহমান সাহেব (পরবর্তীকালে বি,এন,পি’র নেতা ও সাংসদ)। তারা দু’জন সারা শহর ঘুরিয়ে আমাদের পাক হানাদার বাহিনীর ধ্বংসলীলা ও নির্যাতনের কাহিনী বর্ণনা করেছিলেন। সে দৃশ্য ভোলার নয়।
কমরেড আসাদ্দর আলী সাহেব তার শেষ জীবনে উপলব্ধি করেছিলেন, ষাটের দশকে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের বিভাজন ছিল ভুল এবং অবিমৃষ্যকারিতার ফল। তিনি বলতেন, “ধ্রুব তারা দেখে নাবিক তার দিক নির্ণয় করে। ধ্রুব তারার দিকে চেয়ে জাহাজ চালায় না। কিন্তু চীন ও রুশ পন্থিরা চীন ও সোভিয়েতের দিকে চেয়ে দল পরিচালনা করেছেন ফলে দলও এগোয়নি, দেশও এগোয়নি।” তাঁর এ উপলব্ধি যথার্থ।
কমরেড আসাদ্দর আলীর রাজনৈতিক কর্মকান্ড আজীবন কৃষক শ্রমিক ও মেহনতি মানুষের প্রতি নিবেদিত ছিলো। তার অনুসৃত পথ সম্পর্কে মত পার্থক্য থাকলেও তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিলো শোষণ মুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা। তিনি ব্যক্তিগত কোন লাভালাভের উদ্দেশ্যে রাজনীতি করেননি। তিনি ছিলেন একজন ত্যাগী, আপোষহীন লড়াকু দেশপ্রেমিক। তাঁকে নিবেদন করি শ্রদ্ধাঞ্জলি।
তবারক হোসেইন : লেখক, গণ ফোরাম নেতা ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী।
Post a Comment
0 comments
কমরেড আসাদ্দর আলী বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় নাম।তিনি সারাজীবন মেহনতী মানুষের কল্যানে কাজ করে গেছেন।১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে তার অবিস্মরণীয় অবদান ছিল।তিনি কমিনিষ্ট আন্দোলনের পথিকৃত এবং বাংলাদেশের সাম্যবাদী দলের সাবেক সভাপতি ছিলেন।গণ মানুষের নেতা কমরেড আসাদ্দর আলীর স্বরনে একটি ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা মাত্র।সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ।