Feature Label 3

0
কমরেড আসাদ্দর আলী স্মৃতি পরিষদ,কমরেড আসাদ্দর আলী,আসাদ্দর আলী,কমরেড আসদ্দর আলী,আসদ্দর আলী,কমরেড আছদ্দর আলী,ভাষা সৈনিক আসাদ্দর আলী,ভাষা আন্দোলন সিলেট,ময়নূর রহমান বাবুল,লেখক ময়নূর রহমান বাবুল,বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল,কমরেড,comrade asaddar ali,asaddar ali,comrade assador ali,assador ali,moynur rahman babul,

সমাজ হবে সাম্যের। সমাজে থাকবেনা কোন উঁচু নিচু, ধনী গরীব, পুঁজিপতি, পুঁজির পাহাড় আর সর্বহারার হাহাকার। এরকমই সুন্দর একটা সমাজের চিন্তা যাঁর মনে ও কর্মে আজীবন লালন করেছেন। কর্মে ও ধ্যানে প্রতিফলিত করেছেন, প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন, তিনি আসাদ্দর আলী। আপাদমস্তক মনে, ধ্যানে, চিন্তায়, কর্মে ও বিশ্বাসে এবং নিজের জীবন যাপনে আসাদ্দর আলী একজন সাম্যবাদী। প্রকৃত এবং নিখাদ নিখুঁত সাম্যবাদী
আমি এখন আর স্পষ্ট মনে করতে পারিনা, কবে কখন তাঁর সাথে প্রথম আমার দেখা হয়, পরিচয় হয়, এই গণমানুষের বন্ধু আর অকৃত্রিম নেতার সাথে। কিন্তু পরিচয় এবং জানাজানির পর থেকে তাঁর মৃত্যুর আগ পর্য্যন্ত আমার স্মৃতির কনাগুলো নেহায়েতই কমনয়। অন্তত: আমার জন্য অনেক বেশী।
সময়টা ১৯৬৮ কিংবা ’৬৯ হবে। সে আমার অনুমান। কারন তখনও ’৭০ এর নির্বচন হয়নি, তৎকালিন পূর্বপাকিস্তানে। আমার এক চাচা জনাব শামছুল হুদা বাম রাজনীতিতে বিশ্বসী ছিলেন। প্রগতিশীল রাজনীতির একজন কর্মী ছিলেন বলাযায়। সেই সময় বয়স খুব কম ছিল। তা আর বুঝতাম কত ? কিন্তু আমাদের বাড়ীতেই চাচার বৈঠক ঘর (আমরা বলতাম টঙ্গীঘর) প্রায়ই বৈঠক সমাবেশে সরগরম হতো। বিভিন্ন এলাকার লোকজন এখানে আসতেন, বৈঠক হতো। চা নাস্তা হতো। আমরা ছোট বয়সীরা সেখানে পানদান এনে দেয়া বা এজাতীয় কিছু ফরমায়েশ খাটতাম। সেই আলোচনা গুলো যে রাজনৈতিক ছিল এখন তা বুঝতে পারি। সেই চাচা ন্যাপ করতেন। তখনকার ঐসব বৈঠক গুলোতে যেসব গুনধর ব্যাক্তিগনের নাম শুনতাম তাঁদের মধ্যে আব্দুল বারী, বাবু জ্যোতি সোম, জনাব আসাদ্দর আলী ইত্যাদি কিছু নাম মনে পড়ে। জ্যোতি সোম বাবুকে স্পষ্ঠ মনে আছে এখনও। কারন তিনি ধূতি আর পাঞ্জাবী পরতেন এবং মুখে গোঁফ ছিল। অন্যান্যের মধ্যে তাঁকে সহজেই চেনা যেত এবং মনেও থাকতো। কিন্তু আসাদ্দর আলী নামে আমাদের গ্রামেরই আরো এক চাচা ছিলেন। তিনি আমাদের দয়ামীর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানও হয়েছিলেন। অবশ্য তিনি এরকম বাম রাজনীতির সাথে তখন সংশ্লিষ্ট ছিলেননা বলেই জানি। অতএব এসব বৈঠকে হয়তো জননেতা আসাদ্দর আলীই থাকতেন অথবা তাঁর প্রসঙ্গে আলাপ হতো এটা আমার অনুমান হয়। এসব বৈঠকের কোননা কোন বৈঠকে তিনি হয়তো উপস্থিত থাকতেও পারেন। আমার চাচা ন্যাপ করতেন। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল - ‘জাসদ’ সমর্থক ছিলেন। এটা অবশ্য ভিন্ন কারনে। আর কারন হলো: তাঁরই আপন ভাগ্নে আখতার আহমদ ছিলেন জাসদের একজন কেন্দ্রীয় নেতা।
সত্তুর এর নির্বাচনের পূর্বে নির্বাচনী কাজে অনেকেই প্রচার কাজ করতে করতে আমাদের বাড়ীতে এসেছেন। বালাগঞ্জ, ফেঞ্চুগঞ্জ, গোলাপগঞ্জ, বিশ্বনাথ থানা নিয়ে তখন জাতীয় পরিষদের আসন ছিল। তখন আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন এম এ জি ওসমানী। জমিয়ত উলামায়ে ইসলামের ছিলেন মৌলানা নুরুদ্দিন। মওলানা এসে খোঁজ করলে ভিতর বাড়ী থেকে খবর আসতো চাচা বাড়ীতে নাই। আর কাজ করতেন আওয়ামী লীগের পক্ষে। কর্নেল ওসমানী একদিন রাতে অনেক লোকসহ আমাদের বাড়ীতে উপস্থিত। আমরা সবাই ‘কর্নেল ওসমানী’ দেখতে দুপুর রাতে টঙ্গিঘরে গিয়েছিলাম। উল্লেখ্য, তখন তাঁকে কর্নেল ওসমানী বলেই ডাকা হতো।
এসব অস্পষ্ঠ স্মৃতি বাদ দিলে যেটুকু স্পষ্ঠ মনে পড়ে তাহলো: ১৯৮০ থেকে ’৮৪ পর্যন্ত আমি সরকারী এম সি উচ্চ মাধ্যমিক কলেজে এবং সিলেট সরকারী এম সি (তখনকার নাম এরকম ছিল) কলেজে অধ্যয়ন কালিন সময়ে বাড়ী থেকে কলেজে যাওয়া আসার পথে ধোপাদিঘির পারে তাঁর টিনসেডের ঘরে লোকের উপস্থিতি দেখলেই বুঝতাম তিনি হয়তো আছেন তাই মোটর সাইকেলটা ঘরের পাশে দাঁড় করিয়েই আমারও উপস্থিতির জানান দিতাম। অনেক্ষন ধরে তাঁর কথা শুনতাম। তিনি এলাকার কথা, লেখাপড়ার খবর ইত্যাদি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করতেন। কিন্তু তাঁর ঘরে উপস্থিত বেশীরভাগ লোকই দেখতাম নেহায়েত শ্রমিক শ্রেণীর। কোন কোন সময় এটা ওটা সমস্যা, বিচার আচার নিয়েও কথা বলতে শুনেছি। দেশ বিদেশের ইতিহাস ঘঠনা, দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি আর তাত্ত্বীক বিষয়তো আলোচনায় ঘুরেফিরে থাকতোই। এসব শুনতাম। তাছাড়া আমার প্রকাশিতব্য সাহিত্য সংকলনে লেখা চেয়েও তাঁর কাছে কয়েকবার গিয়েছি।
১৯৮৪ এর পরে তাজপুরেই বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দেখা হতো। তাজপুরে উদীচীর অনুষ্ঠান সমূহে কলেজবাড়ীতে তিনি প্রায়ই আসতেন। ’৮৬তে বাংলাদেশ উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী বালাগঞ্জ শাখার সম্মেলন হয়। আমাকে দায়িত্ব দেয়া হয় উপজেলা কমিটির সাধারন সম্পাদক পদে। তিনি আমাকে শুভেচ্ছা জানান।
১৯৮৭ সালে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি বালাগঞ্জ উপজেলা শাখার প্রথম সম্মেলন অত্যন্ত আড়ম্বর আর বিপুল লোকের উপস্থিতিতে তাজপুর কলেজ বাড়ীতে অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলন উদ্ভোধন করেন কমরেড বরুন রায়। অন্যান্য রাজনৈতিক দলের অনেক নেতৃবৃন্দ সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তারমধ্যে জনাব আসাদ্দর আলীও উপস্থিত থেকে সুদীর্ঘ বক্তব্য রাখেন। সেদিনের তাঁর বক্তব্য আমাকে খুবই আপ্লুত করেছিল। তিনি চলমান বিশ্বের বাস্তব অবস্থা এবং সা¤্রাজ্যবাদ নিয়েই বেশী আলোচনা করেছিলেন। উল্লেখ্য, এ সম্মেলনে সিপিবি বালাগঞ্জ শাখার যে কমিটি গঠন করা হয় সে কমিটিতে আমি সাধারন সম্পাদকের দায়িত্ব পাই। এ সম্মেলনে লোকের উপস্থিতি,আয়োজন ইত্যাদি দেখে তাঁর হয়তো মনে খুব রেখাপাত করেছিল, ভাল লেগেছিল। পরে একদিন কথা প্রসঙ্গে আমাকে বলেছিলেন, বাম আন্দোলন আর সংগঠনে সারা জীবন কাজ করেছি কিন্তু তোমাদের সম্মেলনে এবং পার্টিতে লোক সমাগম দেখে খুব ভাল লেগেছে। প্রকৃতই কৃষক, ক্ষেতমজুর শ্রমিক লোকদের জমায়েত দেখে আমি খুব উৎসাহিত হয়েছি। কথায় কথায় তিনি তাও বলেদিলেন সারা জীবনের কর্মপ্রচেষ্ঠায়ও বালাগঞ্জেতো এত লোক পার্টিতে বিশেষ করে সাধারন মানুষকে আনতে পারিনি। তোমরা তা করতে পেরেছ। তিনি শুভেচ্ছা, শুভকামনা এবং ধন্যবাদ জানান এজন্যে। অতি আবেগে কি না জানিনা, তবে তিনি তখন বলেছিলেন ‘এজন্য তোমাদেরকে স্যালুট দেয়া দরকার’। তাঁর এই উক্তি আমাকে খুবই উৎসাহিত করেছিল। আমি তখন অত্যন্ত বিনয়ের সাথে বলি : আপনি জমি চাষ করে, শক্ত মাটি খুঁড়ে দিয়েছিলেন বলেই আজ আমরা ফসল ধরিয়েছি। তাছাড়া আপনার ক্ষেত্রতো শুধু বালাগঞ্জ নয় - সারা দেশ। এমন কি,তাঁর চেয়েও বেশী।
আমি দেখা করতে গেলেই অথবা তাজপুরে কোন ঘরোয়া বৈঠক আলাপে দেখা হলে প্রায়ই আমাকে বইপড়া নিয়ে প্রশ্ন করতেন।এর মধ্যে আমি কি কি বই পড়েছি তা জানতে চাইতেন। কখনও কখনও কি বই পড়বো তা বলেও দিতেন। পার্টি, ক্ষেতমজুরদের কাজ কেমন চলছে তাতো জানতে চাইতেনই।
১৯৮২ সালে জেনারেল এরশাদ নিজের শক্তিবলে আর আমাদের দূর্বলতার সুযোগে চেপে বসলেন জাতির ঘাড়ে। জেনারেল জিয়ার পদাঙ্ক অনুসরন করলেন তিনিও। এক পা যেন বাড়িয়ে সে অনুসরন তার। জিয়া তার রাজনীতিতে দলে ভিড়িয়েছিলেন রাজাকার, স্বাধীনতা বিরোধীদের বেশী। আর এরশাদ পঁচে যাওয়া, হতাশাগ্রস্থ বামপন্থিদের বস্তাভরে জমা করেন তার আঁড়তে।
সে সময় একদিন সকালবেলা তাঁর ধোপাদিঘির পারের বাসায় উপস্থিত হই। প্রায় ঘন্টাখানেক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। এরই মধ্যে কেউ আস্ছেন আবার কেউ যাচ্ছেন। কিন্তু আমি সেদিন একটানা অনেক্ষন বসেছিলাম। কথায় কথায় একসময় হবিগঞ্জের সিরাজুল হোসেন খান প্রসঙ্গে কথা উঠে। সিরাজুল হোসেন খান তখন এরশাদের মন্ত্রী। এক সময় তিনি বলে বসেন, ইতোমধ্যে অনেক অফারতো পেয়েছি, কিছু ডর ধমকও দিয়েছে, কি বল মন্ত্রী হয়েযাব নাকি ? তাঁর জিজ্ঞাসার অস্বাভাবিকতায় আমি হতচকিত হয়ে উঠি। আমি তৎক্ষনাৎ বুঝতে পারিনি যে তিনি আমাকে বা আমার মনোভাব পরীক্ষা করার জন্য তা বলছেন কি না। কিন্তু কিছুক্ষনের মধ্যেই আধশুয়া থেকে উঠে আমার ঘাড়ে একটা মৃদু ঝাকুনী দিয়ে বললেন : ঘাবড়ে গেছ নাকি বাবুল ? সবাই যদি মন্ত্রী হয়ে গাড়ী হাকায় তবে তোমাদের জন্য থাকবেটা কি ? সুন্দর একটা সকালের জন্ম যে তোমাদের জন্য অপেক্ষা করছে...... । কিন্তু সবাই এক হতে পারলে এখনই হয়তো সেই ভোরের সূর্যটার জন্ম অসম্ভব ছিলনা।
বামপন্থিদের ঐক্যের জন্য সব সময় তিনি আক্ষেপ আপসোস করতেন। শুধু আপসোসের বা হাহুতাসের মধ্যেই সিমাবদ্ধ ছিলেননা। তিনি সর্বান্তকরনে চেষ্ঠাও করেছেন। প্রচুর শ্রম এবং চিন্তাকে তিনি ব্যয়ও করেছেন এজন্যে। তিনি মনে করতেন শুধু আমাদের বা পর্শ্ববর্তী দু’একটা দেশের কমিউনিস্টরা এক হয়ে গেলেই সমস্যার সমাধান হবেনা। সারা দুনিয়ার বাম মতাদর্শের ঐক্য একান্তই চূড়ান্ত সমাধান। মার্কস, লেলিন, স্টালিন, মাও বাদীদের অবশেষে যদি এক কাতারে দাঁড়ানো যায় তখনই পুঁজিবাদী সা¤্রাজ্যবাদীদের মোকাবেলা করা যাবে। সাম্যের দুনিয়া প্রতিষ্ঠিত হবে। সে লক্ষ্যে তাঁর কর্ম প্রচেষ্ঠা, কথায় ও কাজে অব্যাহত রেখে এগিয়ে গেছেন। এজন্য তিনি শুধু বাংলাদেশের বামপন্থি নেতা ছিলেন না, এরচেয়েও বড় কিছু হয়তো। এটা তাঁর বুকে রক্তক্ষরনেরও কিছু বাস্তব কারন ছিল। এ দেশে যখন বামদের দুই ধারা সৃষ্টি হয় তখন যেন তাঁর নাড়ীকাঁটা ভাইটা রুশপন্থি হয়ে যান আর তিনি নাড়ী ছেড়ে চলে যান চীনপন্থিতের দলে। যাদের সাথে এরকমই নাড়ীর বন্ধনের মতো একসাথে কাজ করেছেন তাদের অনেকের সাথেই যখন পথের ও মতের দূরত্ব সৃষ্টি হলো এবং পথ হয়ে গেল বন্ধুর, লক্ষ্য হয়ে গেল সুদূর, তখন আশার আলোতো সহসাই যেন দূরে চলে গেল। ১৯৪৭ এর দেশ ভাগের ক্ষয়তো বুকে ঘা ধরে ছিলই।
১৯২৫ সালের ২৫ শে সেপ্টেম্বর সাম্যবাদী এ নেতা জন্ম গ্রহন করেন। তাঁর পিতার নাম মরম আলী। দাদা ছিলেন কুদরত আলী। সিলেট জেলার বালাগঞ্জ উপজেলা, বর্তমানে ওসমানীনগর থানার তাজপুর এলাকার কাজির গাও নামক গ্রামে তাঁর জন§। তাজপুর প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকেই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু। তারপর মঙ্গলচন্ডি নিশিকান্ত হাইস্কুল হয়ে সিলেট শহরে এম সি কলেজে।
বিদ্যালয় মহাবিদ্যালয়ের গন্ডির বাইরে আসাদ্দর আলীর বৃত্ত ছিল অনেক বড় অনেক প্রশারিত। ইতিহাস, দর্শন আর রাজনৈতিক আদর্শের অথবা পৌর বা রাষ্ট্রবিজ্ঞান পড়া তাঁর কোন সীমারেখা হয়তো মাড়াননি। আর এ সবের ফলশ্রুতি এবং তখনকার সময়ের বিশ্বপরিস্থিতি, আমাদের দেশের উপনিবেশিক শাসন শোষনের কাঁটা হয়তো তাঁকে উদ্বোদ্ধ করে সা¤্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদের বিরোধ্যে রুখে দাঁড়াতে। দাঁড়িয়েও যান তিনি। হাইস্কুলে অধ্যয়নকালিন সময়েই শুরু হয় তাঁর সেই পিঁচ্ছিল পথে পথচলা। ছাত্র ফেডারেশনের সদস্য হিসাবে কাজ শুরু হয় যা পরবর্তীতে অনেক পথ মাড়িয়ে একজন মার্কসবাদী তাত্মীক, সাম্যবাদী, সাম্য আর ঐক্যের সমাজ প্রতিষ্ঠার কর্মী ছিলেন। আমৃত্যু তিনি সে সাম্যের সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন যেমন বুকে লালন করেছেন - তেমনি তা প্রতিষ্ঠার জন্য বিরামহীন কাজ করে গেছেন ।
তিনি কবিতা লিখতেন। কিন্তু কবি হতে চাননি। কবিতায় আদর্শ্বের কথা প্রচার করতে চেয়েছেন। গান লিখেছেন। জনসভায়,সমাবেশে তা অনেকেই গেয়েছেন। মানুষকে উদ্বোদ্ধ অনুপ্রানিত করেছে তাঁর গান। ভাল গান করতেন কমরেড আজহার আলী। আসাদ্দর আলীর লেখা গান তিনি রূপ রস সুর দিয়ে তা পৌঁছে দিতেন সাধারন খেটে খাওয়া মানুষের হৃদয়ের গহীনে। ফুটবল খেলতেন আসাদ্দর আলী। গোলবারে তাঁর বল দক্ষতার সাথে যেমন পৌঁছাতে পারতেন তেমনী আজীবন চেষ্ঠা করেছেন সাম্যবাদী সমাজ ব্যবস্থার চিন্তাটা আমাদের সমাজে পৌঁছে দিতে, প্রতিষ্ঠা করতে।
সিলেট শহরে তাঁর একটা প্রেস ছিল। সেখানে এজাতীয় প্রকাশ, মুদ্রনই বেশী হতো। ‘সিলেট প্রিন্টার্স’ নামের এই প্রেসটা তাঁর একটা কর্মক্ষেত্র ছিল বলাযায়। তাঁর আগে বনবিভাগে চাকুরী নিয়ে তা ছেড়েদেন, কারন হয়তো এটা তাঁর জন্য প্রকৃত কর্মস্থল নয়। তিনি হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করতেন, তাও তাঁর ব্যবসা বা অর্থ উপার্জনের জন্য নয়। গরীব শ্রমিক কর্মীগনকে সহজলভ্য চিকিৎসা দিতেন।
অর্থবিত্তের কাছে ঘেঁষতে চাননি। তাঁর মতো কেউ তা কখনো চায়ওনা - এটাই নিয়ম। তিনি ঘর করেছিলেন ধোপাদিঘির পূর্বদক্ষিন পারে। ‘বাড়ী’ করেন নি। বাড়ীর তাঁর দরকারও ছিলনা। টিনসেড ঘরে যে লোকগুলো এসে বসে মুখরিত করতো, বাড়ীহলে তারা সেখানে যেতনা। সারা দেশেটাকেই তিনি একটা বাড়ী করতে চেযেছিলেন। বাগান বাড়ী। যে বাড়ী মুখরিত করতো বাংলার আবাল বৃদ্ধ বনিতা। থাকতো সুখে, স্বাচ্ছন্দে। সাম্য মৈত্রী আর স্বাচ্ছন্দ নিয়ে। তিনি বিভিন্ন পত্রিকায় তাত্ত্বীক রচনা সমূহ লিখেছেন। দলের মুখপত্র ‘গণশক্তি’র সম্পাদক ছিলেন তিনি।
এলাকার শিক্ষা ও সামাজিক উন্নয়ন ক্ষেত্রে আসাদ্দর আলীর অনেক অবদান রয়েছে। তাঁর অক্লান্ত প্রচেষ্ঠা আর পরিশ্রমের ফসল, তাজপুর কলেজ। মুলত: তাঁরই অনুপ্রেরনায় উদ্ভোদ্ধ হয়ে জনাব আজহার আলী তাঁর নিজের অনেক মূল্যবান, কয়েক কোটিটাকার ভূমি কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য দান করেদেন।
ছাত্র ফেডারেশন নামক সংগঠনের মাধ্যমে তাঁর রাজনৈতিক পথচলা শুরু। তারপর ছাত্র ইউনিয়ন, যুবলীগ, কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ, আওয়ামী লীগ হয়ে মৃত্যুর আগপর্যন্ত ছিলেন সাম্যবাদী দলের পলিটব্যুরোর চেয়ারম্যান। দল নিষিদ্ধ থাকায় কর্মপন্থা চালিয়ে যেতে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন নামের আবরনে মিশতে হয়েছে তাঁকে।
বামরাজনীতির কন্ঠকময় পথে কাজ করতে গিয়ে আসাদ্দর আলীকে জীবনের অনেক গুলো দিন কারান্তরালে কাঁটাতে হয়েছে। বড়কোন আন্দোলনের ডাক আসলেই, অথবা দেশে নির্বাচন আসবে এরকম ঘোষনা হলে প্রথমেই এসে আসাদ্দর আলীকে পুলিশ খোঁজাখোঁজি শুরু করতো এবং অনেকাংশে গ্রেপ্তারও করে নিয়ে যেত। গ্রেপ্তার এড়াতে তিনি জীবনের আরো বড় একটা সময় আত্মগোপনেও কাঁটিয়েছেন।
সিলেট সদর থানার লালাবাজারের কাছে গোয়াল গাও-এ আমার এক বিয়াইর বাড়ী। বিয়াইর নামও আসাদ্দর আলী। দু’জনে খুব সখ্যতা ছিল। আত্মগোপনে থাকাকালিন বিভিন্ন সময় আসাদ্দর আলী এ বাড়ীতেই থাকতেন। আমি বেড়াতে গেলে আমার বিয়াইয়ের কাছে রাত জেগে জেগে আসাদ্দর আলীর জীবনের বিভিন্ন কথা শোনতাম। স্মৃতি থেকে অনেক কথা আসাদ্দর আলী সম্পর্কে আমার কাছে আমার বিয়াই বর্ননা করতেন আর আমি তন্ময় হয়ে শুনতাম। এটা ১৯৮৭-৮৯ এর সময়কালে কথা।
কোন সহকর্মী, সহযাত্রী, আত্মীয়বন্ধুর কাছ থেকে শুনেই কি এ কিংবদন্তী পুরুষের বর্ন্যাঢ্য জীবনের কাহিনী শেষ করা যাবে ! সব কিছু কি আর জানাযাবে ?
সংগ্রামী জীবনের শেষ প্রান্তে এসে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন শহীদুননেছা শান্তি’র সাথে। কিন্তু মরনব্যাধি ক্যানসার তাঁদের দাম্পত্য জীবনের মাত্র তের বছর কালে আসাদ্দর আলীকে ছিনিয়ে নেয়।
১৯৯০ সালের ২রা ফেব্রুয়ারী। আর সাময়িক আত্মগোপন নয় - চির প্রস্থান। বর্নাঢ্য এ জীবনের শেষ যতিচিহ্ন। মৃত্যুকে আলিঙন করেন আসাদ্দর আলী। ঢাকা থেকে তাঁর দলের এবং বিভিন্ন শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দ শবদেহ গাড়ীতে করে নিয়ে আসেন তাজপুরে। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে আমরা অশ্রান্ত কাজ করছি। এমন কঠিন সময়ে আমরা আরো এক বিয়োগ মাথায় নিয়ে তাজপুরস্থ তাঁদের কবরস্থানে ঢাকা সিলেট মহাসড়কের পাশে তাঁকে সমাহিত করি। অদুরেই কমরেড আজহার আলী শুয়ে আছেন আরেক কবরে। পূর্বসূরীদের চির বিশ্রামাগারের দিকে চেয়ে কানে যেন শুনি তাঁর নিজেরই লিখা নতুন দিন শিরোনামের কয়েকটি পংক্তি :
                                               ‘বিদয়িী সাথী, তোমার তীব্র ভালবাসার সুরা
                                                       আমার মনের মনিকোঠায় থাক
                                                            রিক্ত মনের তীব্র অভিজ্ঞতা
                                                     তার সাথে আজ এক হয়ে যাক যাক।
                                                নতুন সাথী, তোমার তিক্ত কঠোর আলিঙ্গন
                                                     আমার চলার পথের বাঁকে বাঁকে
                                                        যেন নিত্য নতুন শক্তি নিয়ে
                                                        মাটির মত সঙ্গী হয়ে থাকে।’
                                               (আসাদ্দর আলী: রচনা-২৭-০৫-১৯৫০)
তাজপুর কদমতলা পেরিয়ে বাজার সংলগ্ন কবরস্থান। বসন্তের খরায় মরে শুকিয়ে যাওয়া ঘাষের উপর দিয়ে মাঠিতে, দু’চোখ দিয়ে দু’টি গালবেয়ে গড়িয়ে পড়ে দু’ফোটা অশ্রু। শুকনো তৃষ্ণার্ত মাটি নিমিশেই শুষে নেয় লবনাক্ত পানি ফোঁটাদ্বয়। আমি পিছনে ঢাকা সিলেট মহাসড়কের দিকে তাকাই। ভিজা চোখে ঝাপসা দেখতে পাই দু’দিকের দু’টো গাড়ী এ’কে অপরকে অতিক্রম করছে তাদের গন্তব্যের পথে।
লন্ডন ০৮ ডিসেম্বর ২০১২
(চোখের দেখা প্রাণের কথা, পৃষ্ঠাঃ ৬২)

Post a Comment

কমরেড আসাদ্দর আলী বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় নাম।তিনি সারাজীবন মেহনতী মানুষের কল্যানে কাজ করে গেছেন।১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে তার অবিস্মরণীয় অবদান ছিল।তিনি কমিনিষ্ট আন্দোলনের পথিকৃত এবং বাংলাদেশের সাম্যবাদী দলের সাবেক সভাপতি ছিলেন।গণ মানুষের নেতা কমরেড আসাদ্দর আলীর স্বরনে একটি ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা মাত্র।সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ।