১৯১৭ সালে রাশিয়ায় অক্টোবর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পর সোভিয়েত-রাজ প্রতিষ্ঠিত হয়। বিশ্বের শ্রমিক আন্দোলনের এক নবজাগরণ দেখা দেয়। বিশেষভাবে এরপর থেকে ইতিহাসে দেখা যায় ইউরোপ ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে কমিউনিস্ট পার্টি গঠনের তোড়জোড় প্রবল হয়ে উঠেছে। ১৮৮৯ সালে গঠিত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সুবিধাবাদী ও সংশোধন- বাদীদের আস্তানায় পরিণত হওয়ার ফলে এর ভরাডুবি ঘটে। অতঃপর ১৯১৮ সালে মহান লেলিনের নেতৃত্বে গঠিত হয় তৃতীয় আন্তর্জাতিক। এর ফলে বিশ্ব ইতিহাসে একটি নতুন যুগের সূচনা হল। এই আন্তর্জাতিকে ইউরোপ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের বিপ্লবী কমিউনিস্টরা যোগদান করেন। দেশে দেশে কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে উঠতে থাকে। এই পরিস্থিতিতে ভারতেও ১৯২১ সালে গড়ে উঠে কমিউনিস্ট পার্টি। বৃটিশ সা¤্রাজ্যবাদী শাসকদেও কঠোর নিয়ন্ত্রণ, ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের মধ্যেও কমিউনিস্ট পার্টি ভারতের বহু জায়গায় বিস্তার লাভ করে। তৎকালীন বাংলা প্রদেশের কলকাতায় এই পার্টির শক্ত ঘাঁটি গড়ে উঠে। বিস্তার লাভ করে আসাম ও আসামের অন্তর্ভুক্ত সিলেট জেলা পর্যন্ত। তিন দশক পওে পঞ্চাশের দশকে আমি জানতে পারলাম সিলেট অঞ্চলে যারা কমিউনিস্ট পার্টিও সদস্য হয়েছিলেন তাঁরা হলেন অজয় ভট্টাচার্য্য, লালা শরদিন্দু দে, প্রবোধানন্দ কর, দীনেশ চৌধুরী, প্রসূন কান্তি রায় (বরুণ রায়), লাল মোহন রায় প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ। তার পরবর্তী পর্যায়ে পাকিস্তান আমলে গোপন কমিউনিস্ট পার্টির গোপন সদস্য যারা হয়েছিলেন তাদের কাজ কর্মের ভিতর দিয়ে তাঁদের জানা গিয়েছে। এর মধ্যে তারা মিয়া ছিলেন প্রকাশ্য কমিউনিস্ট।
বিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশের দশক। চার পাঁচ বছরের মধ্যেই পাকিস্তানের শাসক শ্রেণীর চরিত্র প্রগতিশীলদের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। জমিদার, জায়গীরদার, জোতদার, মহাজন এবং বৃটিশ সা¤্রাজ্যবাদেও পোষা দালালরাই যে ভারত-পাকিস্তান দুই দেশের সরকার দখল করে রেখেছে তা বুঝতে কারো কষ্ট হয়নি। মুসলিম লীগের প্রতি মোহভঙ্গ শুরু হয় অনেকেরই। যে দিকে তাকাই দেখি জমিদার, জোতদার আর মুৎসুদ্দিরাই মন্ত্রী, এম.এল.এ এবং সব কিছুর খয়েরখা। শ্রমিক-কৃষক তাদের হুকুমের চাকর। বিতৃষ্ণায় ভওে উঠল আমার মনটা। ভাবতে লাগলাম এ জগদ্দল পাথর সরাবার উপায়টা কি?
পড়াশুনার জন্য সিলেট গেলাম। সেখানে যেসব মহান ব্যক্তিবর্গের সংস্পর্শে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম তারা হচ্ছেন আসাদ্দর আলী, তারা মিয়া, এডভোকেট মনির উদ্দিন, পীর হবিবুর রহমান, নূরুর রহমান ও ওয়ারিছ আলী। ওয়ারিছ আলী মাধ্যমে আমি আসাদ্দর আলীর সাথে পরিচিত হই। ধীওে ধীওে ঘনিষ্টতা বেড় যায়। আজে বাজে গল্প গুজবের মানুষ তিনি ছিলেন না। রাজনৈতিক বিষয়াশয় নিয়েই তিনি আলোচনা করতেন। ভাববাদের চিন্তা চেতনা থেকে আমার থাকত নানা রকমের প্রশ্ন। আর দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদী দর্শনের বৈজ্ঞানিক যুক্তির মাধ্যমে তিনি যে উত্তর দিতেন তা খন্ডানোর কোন উপায় আমার ছিল না। বোকা হয়ে বসে থাকতাম। তাঁর বুঝানোর কায়দা ও আলোচনার মধ্যে এমন একটা আন্তরিকতা ও ¯েœহপূর্ণ মেজাজ ছিল যে, বিতর্কজনিত কোন রাগের অবকাশ ছিল না। তখনকার ঐ সময়ে আমি ছিলাম আধ্যাত্মবাদী ভাববাদেও একজন সমর্থক। ইসলামী শাসনতন্ত্র, ইসলামী আইন কানুন প্রভৃতি নিয়ে তাঁর সাথে অনেক কথাবার্তা হত। লৌকিক রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা সহ সমস্ত প্রশ্নগুলি তিনি এমন নির্ভুলভাবে ব্যাখ্যা করতেন যে, পরবর্তী প্রশ্নের সুযোগ থাকত না। বৈজ্ঞানিক যুক্তিকে তো আর গায়ের জোড়ে সরানো যায় না। দলে ভিড়ানোর জন্য বুর্জোয়া রাজনীতিবিদের মতো ছলচাতুরী আর মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া একজন কমিউনিস্টের কৌশল হতে পারে না। তত্ত্ব যদি পছন্দ হয় তা হলে প্রয়োগের জন্য নিজেই দল বাছাই করে নেও- এই কৌশলই অবলম্বন করতেন আসাদ্দর আলী। তাই সহকর্মী সবাই তাঁকে ভালবাসত ও শ্রদ্ধা করত।
নিজেকে অহেতুক জাহির করার অভ্যাস তাঁর ছিল না। কমিউনিস্ট পার্টির নিয়ম শৃংখলা ও গোপনীয়তার দিকটা রক্ষা করা তখন খুবই প্রয়োজন ছিল। তিনি পার্টির শৃংখলা মেনে চলতেন। তৎসত্ত্বেও প্রতিক্রিয়াশীল সরকার ও সা¤্রাজ্যবাদীদের ট্রেনিংপ্রাপ্ত সরকারী গোয়েন্দা বিভাগ জানত তখনকার দিকে গোপন কমিউনিস্ট পার্টির সাথে কারা যুক্ত ছিলেন। সুযোগ আসলেই তাদের গ্রেফতার করা হত। ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে ৯২ (ক) ধারা জারি করার পর ব্যাপক ধরপাকড় করা হয়। সিলেটে আসাদ্দর আলী সহ কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়। আসাদ্দর আলীর সাথে আমার সম্পর্ক গোয়েন্দারা জানত। তাই কয়েকদিন পরে শমসেরনগর থেকে আমাকেও গ্রেফতার করা হয়। সিলেট কারাগাওে গিয়ে দেখি রাজবন্দীদেওে দুই ভাগে বিভক্ত কওে দুইটি ওয়ার্ডে রাখা হয়েছে। গণতান্ত্রিক পার্টিও সদস্য এডভোকেট মনির উদ্দিন সহ উপরে উল্লেখিত সকল কমিউনিস্টদেও রাখা হয়েছে স্বতন্ত্র ওয়ার্ডে। আর আসাদ্দর আলী ও পীর হবিবুর রহমান সহ আওয়ামী লীগ ও তৎকালীন কংগ্রেসের সদস্যদেও রাখা হয়েছে অপর ওয়ার্ডে। জেল হাসপাতাল ছাড়া একে অন্যেও দেখা সাক্ষাতের সুযোগ ছিল না। গ্যাসটিকের রোগী ছিলেন আসাদ্দর আলী। আমারও ছিল এই রোগ। তাই দুজনকেই হাসপাতালে ভর্তি করা হল।
রোগী আসাদ্দর আলীকে নানা প্রশ্ন কওে আমি ত্যক্ত বিরক্ত করেছি। কিন্তু তার মধ্যে বিরক্তির কোন লক্ষণ দেখা যায়নি। খুশ মেজাজে ধীর গম্ভীরভাবে তিনি প্রশ্নগুলি শুনতেন এবং ধীওে ধীওে উত্তর দিতেন। জমিদার, জোতদার, বুর্জোয়া, পেটিবুর্জোয়া রাজনীতিবিদদেও মেজাজ আর একজন কমিউনিস্টেও মেজাজ ও গুনাবলীর মধ্যে কত যে তফাৎ তার জ্বলন্ত প্রমাণ পাওয়া গেল কারাগাওে বন্দী ও হাসপাতালে রোগশয্যায় শায়িত কমরেড আসাদ্দর আলীর কাছ থেকে। আমার রাজনৈতিক জীবনের সূচনালগ্নে আসাদ্দর আলীর উন্নত চরিত্র ও কমিউনিস্ট গুনাবলী দেখে আমার মনোজগতে সামন্তবাদী সমাজ ব্যবস্থায় সৃষ্ট চিন্তা চেতনাও দৃষ্টিভঙ্গি ওলট পালট হয়ে গেল। যে কমিউনিজমের বিরুদ্ধে এতদিন কঠোর সমালোচনা করেছি, আসাদ্দর আলীর সংস্পর্শে এসে সেই কমিউনিজম জিনিষটা যে কী, তা জানবার ও বুঝবার আগ্রহ আমার তীব্র হয়ে উঠল।
জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর আমাদের সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ট হয়ে উঠল। রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কাজে কর্মে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা স্বাভাবিকভাবেই বৃদ্ধি হল। সিলেট শহরে যারা সংগঠনিকভাবে নেতৃত্বের আসনে ছিলেন আসাদ্দর আলীও তন্মধ্যে একজন ছিলেন। তখনকার দিনে সৎ ও চরিত্রবান ছাত্র ও যুবকদের বিভিন্ন সংগঠনের অন্তর্ভূক্ত করা হত। চরিত্রহীন লোকদেও কোন অবস্থায় কোন পদে বহাল করা হত না। বুর্জোয়া, পেটিবুর্জোয়া, সুবিধাবাদী, ধুরন্ধর ও প্রতারক প্রকৃতির লোকদেও সম্পর্কে কমিউনিস্ট পার্টি খুবই সতর্কতা অবলম্বন করত। আমাকে আসাদ্দর আলী কিভাবে দেখছেন তা আন্দাজ করতে না পারলেও তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, আমার আগের চিন্তা চেতনার পরিবর্তন ঘটতে শুরু করেছে। তাই তিনি কিছুটা নিঃসংকোচে মাঝে মাঝে কমিউনিজম সম্পর্কে আলোচনা করতেন। এতে অনেকটা বিষয় আমার কাছে পরিষ্কার হয়েছে। তখন কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ছিল। গোটা পার্টি গোপন ছিল। গোপন পার্টিতে গৃহীত কৌশল অবলম্বনে তারা কাজ করতেন। নিজেকে জাহির করতেন না। ভারত, পাকিস্তান উভয় দেশেই কমিউনিস্টদের উপর নির্যাতন হয়েছে। উভয় দেশেই সরকার ছিল জমিদার, জায়গীরদার, জোতদার ও সা¤্রাজ্যবাদী লগ্নিপুঁজির মহাজন মুৎসুদ্দি বুর্জোয়াদের হাতে। সাম্প্রাদায়িকতার বিষাক্ত হাওয়ায় শ্রমিক কৃষক সহ জনগণ বিভ্রান্ত ও বিপথগামী হয়ে পড়েছিলেন। পরিস্থিতিটা হয়ে উঠেছিল বড়ই কঠিন ও জটিল। এই রুপ একটা বিপদ সংকুল পরিবেশ পরিস্থিতির মধ্যে যেসব কমিউনিস্ট সিলেট শহরে কাজ করেছেন আসাদ্দর আলী সহ একটি গ্রুপ ছিল তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য। তাঁরা সবাই ছিলেন আদর্শবান, চরিত্রবান ও নিষ্ঠাবান লোক।
১৯৪৭ থেকে ১৯৫২ পাকিস্তানে এই পাঁচ বছরের মধ্যে ভাষা আন্দোলন এক ঐতিহাসিক ঘটনা। ছাত্র, যুবক, শ্রমিক, কৃষক সবাই এই আন্দোলনে শরিক ছিলেন। বাঙ্গালী মুৎসুদ্দি বুর্জোয়ারাও তাদের বাছাই করা শ্লোগান- “উর্দু নয় বাংলা, বাংলা ভাষা হবে রাষ্ট্রভাষা” এই রুপ উগ্র জাতীয়তাবাদী শ্লোগান তুলে বাজিমাৎ করতে পারেনি। “পক্ষান্তরে কমিউনিস্ট নেতৃত্বের শ্লোগান ছিল “অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, সকল ভাষার সমান মর্যাদা চাই, বাংলা সহ সকল জাতিসত্তার ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করতে হবে”। এই দাবীগুলি ছিল তখনকার দিনে ন্যায়সঙ্গত গণতান্ত্রিক দাবী। পাকিস্তানের সকল জাতিসত্তার মানুষকে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ করার এবং আন্দোলন গড়ে তোলার পক্ষে এইসব দাবী সহায়ক ছিল। সা¤্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ ও স্বৈরাচারী শাসক শোষকদের উচ্ছেদ করার সংগ্রামে প্রত্যেকটি জাতিসত্তার নির্যাতিত, নিপীড়িত, শোষিত জনগণকে এতে ঐক্যবদ্ধ করার একটি বৃহৎ ক্ষেত্র সৃষ্টি করা যেত। আমরা জানি বাঙালি মুৎসুদ্দি ও অবাঙালি মুৎসুদ্দি বুর্জোয়াদের মধ্যে সূচনালগ্ন থেকেই শ্রেণী স্বার্থগত দ্বন্দ্ব বিরোধ সৃষ্টি হয়েছিল। ১৯৭১ সালে এই দ্বন্দ্ব বিরোধটাই ব্যাপক আকার ধারণ করেছিল।
শুধু ভাষা আন্দোলন নয়, প্রতিটি আন্দোলনেই আসাদ্দর আলী শরিক ছিলেন। যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে তিনি অবিশ্রান্তভাবে কাজ করেছেন। আইয়ুব খাঁর সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে দীর্ঘ দশ বছর একটানা সংগ্রামে লিপ্ত ছিলেন। ১৯৬৮-৬৯ এর গণ আন্দোলনে অবিরাম কাজ করেছেন।
ধোপাদিঘীর পূর্বপারে আসাদ্দর আলীর বাসাটা ছিল ছাত্র যুবক সহ বৃদ্ধ প্রৌড় সবার জন্য সর্বক্ষণ অবারিত এক অফিসের মতো। দিন রাত এখানে প্রগতিশীল রাজনীতির চর্চাই হত। তাঁকে কেন্দ্র করে বেশ কিছু ছাত্র যুবক প্রগতিশীল রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। তাঁর এমনই এক ব্যক্তিত্ব ছিল যে, কেউ তাঁর সংস্পর্শে গেলে তাঁকে ছেড়ে যেত না। বৃহত্তর সিলেটের বিভিন্ন জায়গা থেকে যারা সিলেট সদওে আসতেন তারা সবাই আসাদ্দর আলীর সাথে সাক্ষাৎ করে আলাপ আলোচনা করতেন। তিনি ছিলেন একজন জ্ঞানী ও অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ। মাঝে মাঝে তিনি কবিতাও লিখতেন। তাই অনেকে তাঁকে ‘কবি সাহেব’ বলেও ডাকত। তিনি ছিলেন এমন এক নিরহংকার রাজনীতিবিদ যিনি নিজের সুনাম অর্জনের জন্য নিজেকে জাহির করেননি। কমিউনিস্ট পার্টির মানদন্ডে শ্রেণী বিচারে তিনি ছিলেন কৃষক পরিবারের সদস্য। শ্রেণীগতভাবে পার্টিতে তাঁর মর্যাদা বেশী হওয়ার কথা। মার্কসবাদ লেনিনবাদে দৃঢ় আস্থা থাকলে এবং সর্বহারার গুণাবলী অর্জন করলে পার্টির সদস্য হওয়া যায়। সুদখোর, মদখোর, প্রতারক ও শোষকরে স্থান কমিউনিস্ট পার্টিতে নেই।
তৎকালীন গোপন কমিউনিস্ট পাটির সিলেট জেলা কমিটির সদস্য ছিলেন তিনি। অন্যান্য সদস্যের মধ্যে ছিলেন পীর হবিবুর রহমান, তারা মিয়া, হবিগঞ্জের মঈন উদ্দিন এবং সেক্রেটারী ছিলেন দ্বিজেন সোম। কেন্দ্রীয় সেক্রেটারী বারিন দত্ত (সালাম ভাই) প্রতিটি সভায় কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি হিসাবে উপস্থিত থাকতেন। আসাদ্দর আলী পার্টির বৈঠকে প্রতিটি বিষয় গভীর মনোযোগ সহকারে শুনতেন এবং বিস্তারিত আলোচনার মাধ্যমে গৃহিত সিদ্ধান্ত মেনে নিতেন। পার্টির গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতা সব সদস্যই মানতেন। তখনকার ঐ সময়ে পার্টির কোন বিপ্লবী কর্মসূচী ছিল না। মৌলানা ভাসানীর আওয়ামী লীগের ভেতর থেকে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটানোর কাজটাই ছিল প্রধান। কাজেই পার্টির জেলা কমিটির যারা সদস্য তাদেরকে সেই ভাবেই কাজ করতে হত। সেই সময় পার্টির পরিচালনায় কোন শ্রেণী সংগঠন গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। পঞ্চাশের দশকে মৌলানা ভাসানী রংপুর জেলায় সর্ব প্রথম কৃষক সম্মেলন আহবান করেন। আসাদ্দর আলীসহ অসংখ্য প্রতিনিধি সেই সম্মেলনে যোগদান করেন। সেখানে গঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তান কৃষক সমিতি। অতঃপর কমিউনিস্ট পার্টি কৃষক সমিতিতে কাজ করার সুযোগ পায়।
আসাদ্দর আলীর একটা অভ্যাস ছিল এই যে, কোন সংগঠনের কোন পদ পাওয়ার জন্য তিনি লালায়িত বা উৎসুক হতেন না। সহকর্মীরা জোর করে তাঁকে পদে বহাল করতেন। পদে থাকুন আর না-ই থাকুন তিনি প্রতিটি সংগঠনেই নিরলসভাবে কাজ করতেন। প্রতিটি গণ সংগঠন ও শ্রেণী সংগঠনের প্রতিটি কাজে তিনি অংশগ্রহণ করেছেন সমানভাবে। কাজে কর্মে তাঁর কোন অবহেলা ছিল না। কৃষক সমিতিতেও তিনি কাজ করতেন। তাঁরই উদ্যোগে বালাগঞ্জের কাশিকাপন গ্রামে একবার কৃষক সমিতির জেলা কমিটির একটা বর্ধিত সভা করেছিলেন। ষাটের দশকে যখন চা শ্রমিকদেও ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন গড়ে উঠল তখন আসাদ্দর আলী ও এডভোকেট মনির উদ্দিনকে একান্ত সহযোগী হিসেবে চা শ্রমিকরা পেয়েছেন তাদের পাশে। জটিল পরিস্থিতিতে খেয়ে না খেয়ে দিন রাত অতিবাহিত করেছেন তাঁরা সংগঠনের অফিস শমসের নগরে। তাঁদের সেই মেহনত, সেই কষ্ট ভুলবার নয়।
বলতে হয় অকালেই মৃত্যুবরণ করেছেন আসাদ্দর আলী। সেই গ্যাস্টিকের রোগ, তারপর ক্যান্সার। নিজের শরীর স্বাস্থ্যের দিকে নজর দেওয়ার সময় পাননি তিনি। সেই কর্মবীর আসাদ্দর আলীর মৃত্যুর পর তাঁর রাজনৈতিক জীবনের মূল্যায়ন করতে হলে সর্বাংশে কমিউনিস্ট আসাদ্দর আলীই আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠেন। “মানবতাবাদী, মানবদরদী, দাতা, দয়ালু, গরীব দরদী, শ্রমিক কৃষকের বন্ধু”- এসব করুণা বিতরণকারী বিশেষণ কোন কমিউনিস্টের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করার প্রয়োজন নেই। তাঁকেও আমরা সামন্ত বুর্জোয়া কায়দায় সেভাবে চিহ্নিত করতে পারি না। শ্রমিক কৃষক সহ মেহনতি জনতার মুক্তির লক্ষ্যে সারা জীবন তিনি কমিউনিস্ট পার্টিও কাজে ব্যয় করেছেন। নাম করা নেতা হওয়ার মোহ তাঁর ছিল না। এদেশের নির্দিষ্ট আর্থসামাজিক পরিবেশে একজন কমিউনিস্টের যা করণীয় তা সম্পন্ন করার দিকেই তার মনোযোগ ছিল বেশী। তিনি এ বিষয়টা ভালভাবেই উপলব্ধি করেছিলেন যে, সা¤্রাজ্যবাদ ও সামন্তবাদকে উচ্ছেদ করে অর্থাৎ জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করেই সমাজতন্ত্রেও লক্ষ্যে পৌঁছানোর প্রচেষ্টা চালাতে হবে। কিন্তু তাঁর এই মহৎ ও নির্ভুল চিন্তাকে কাজে পরিণত করা সম্ভব হয়নি। কমিউনিস্ট পার্টি এই কাজে ব্যর্থ হয়েছে। তখনকার পার্টি এরুপ কোন রণনীতি, রণকৌশল গ্রহণ করতে পারেনি। মার্কসীয় মতবাদের তিনটা অংশ যথা, দর্শন, রাজনৈতিক অর্থনীতি (ঢ়ড়ষরঃরপধষ বপড়হড়সু) এবং বৈজ্ঞানিক কমিউনিজম। মার্কস ও এঞ্জেলসের প্রতিষ্ঠিত এই মতবাদ এক শতাব্দীরও উর্দ্ধকাল যাবত ক্রমাগত বিকাশ লাভ করে আসছে। সা¤্রাজ্যবাদী যুগ ও তৎসহ সর্বহারার বিপ্লবের যুগে এই বিজ্ঞানের আরও বিকাশ ঘটেছে মহান লেনিনের তত্ত্বগত গবেষণা ও সার্বিক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের মাধ্যমে। এর ফলে মহান লেনিনের নাম সংযুক্ত হয়ে এর নাম হয়েছে মার্কসবাদ লেনিনবাদ। এই বিজ্ঞান সমাজ বিকাশের নিয়মাবলীকে নির্ভুলভাবে বিচার বিশ্লেষণ করে। এটা হচ্ছে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ও সর্বহারার একনায়কত্ব সম্পর্কিত বিজ্ঞান। সর্বোপরি এটা হচ্ছে সমাজতান্ত্রিক ও সাম্যবাদী সমাজ নির্মাণের বিজ্ঞান। এই বিজ্ঞান যারা আয়ত্ব করেন এবং প্রয়োগ করতে সচেষ্ট হন তারাই হচ্ছেন সাচ্চা বিপ্লবী কমিউনিস্ট। এই তত্ত্বগুলিকে সূক্ষ্মভাবে এবং সুবিধাবাদী কৌশলে যারা পরিবর্তন সংশোধন করে তারাই সংশোধনবাদী বলে আখ্যায়িত হয়। লেনিনের কথায় সংশোধনবাদ হচ্ছে, ‘শ্রমিক শ্রেণীর কাতারে বুর্জোয়া প্রভাব।’
এখন প্রশ্ন হচ্ছে আসাদ্দর আলী এই বিষয়গুলি কতটুকু আয়ত্ব করেছেন এবং প্রয়োগের ক্ষেত্রে কতটুকু অবদান রেখেছেন? এই প্রশ্নে জবাব নিহিত রয়েছে বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে এক মহাবিতর্কের সময়ে তাঁর ভূমিকা ও পার্টিগত অবস্থানের মধ্যে। এই বিতর্কিত পরিস্থিতির মধ্যে ১৯৬৭ সালে পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। সিলেট জেলা কমিটিও দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। এই পর্যায়ে কমরেড আসাদ্দর আলী মার্কবাদ-লেনিনবাদের নির্ভুল লাইন গ্রহণ করতে দ্বিধা করেননি। সংশোধনবাদী ও সুবিধাবাদী ও সুবিধাবাদী লাইন পরিত্যাগ কওে তিনি সঠিক বিপ্লবী লাইন গ্রহণ করেছিলেন। ১৯৭০ সাল পর্যন্ত এভাবেই তিনি সংশোধনবাদেও বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে গেছেন। তিনি পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি (এম.এল) এর সাথে যুক্ত ছিলেন। এই পার্টির নেতৃত্বে ছিলেন আব্দুল হক, মোহাম্মদ তোয়াহা ও সুখেন্দু দস্তিদার। ১৯৬৭ সালেই এই পার্টির গোপন কংগ্রেসে ‘স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলার’ কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়েছিল। এই কংগ্রেসে আসাদ্দর আলীর উপস্থিত ছিলেন।
১৯৭১ সালর ঘটনাবলীকে বিচার বিশ্লেষন করার ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (এম.এল.) এর মধ্যে দেখা দেয় মতভেদ। এই মতভেদ টা খুবই জোরালো হয়ে উঠে। পরিশেষে এই পার্টিও দুইভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। এক ভাগের নেতৃত্বে রইলেন আব্দুল হক ও অজয় ভট্টাচার্য সহ নেতৃবৃন্দ এবং অপরভাগে ছিলেনন মোহাম্মদ তোয়াহা ও সুখেন্দু দস্তিদার। তারা নোয়াখালিতে অনুষ্ঠিত এক বর্দ্ধিত প্লেনামে তাদের পার্টির নাম রাখেন সাম্যবাদী দল। ১৯৭৩ সালের পর আসাদ্দর আলী এই দলে যোগদান করেন। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি এই দলেই কাজ করেছেন। ১৯৭৯ সালে জিয়াউর রহমান যে নির্বাচনের ব্যবস্থা করেছিলেন সেই নির্বাচনে সাম্যবাদী দল অংশগ্রহণ করেছিল। আসাদ্দর আলীকেও নমিনেশন দেওয়া হয়েছিল। একমাত্র মোহাম্মদ তোয়াহা ছাড়া এই দলের কোন প্রার্থী নির্বাচিত হতে পারেননি।
আসাদ্দর আলী সাম্যবাদী দলের কেন্দ্রীয় সেক্রেটারীর পদেও কাজ করেছেন। তিনি এই দলের সাপ্তাহিক পত্রিকা গণশক্তির সম্পাদক হিসাবে কিছুদিন কাজ করেছেন। এই পার্টিতে তাঁর প্রচুর অবদান রয়েছে।
১৯৫৪ থেকে ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত কমরেড আসাদ্দর আলীর সাথে একত্রে কাজ করেছি। অনেক কিছুই তাঁর কাছ থেকে শিখেছি। কোনদিন কল্পনাও করতে পারিনি যে এই কমরেড রাজনীতির এক অবস্থানে আর আমি থাকব অন্য অবস্থানে। কিন্তু পরিবর্তনশীল বিশ্ব পরিক্রমায় তা-ই ঘটে গেল। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিসরে আদর্শগত মতপার্থক্যের ফলশ্রুতিতে অপরিহার্যভাবেই আমরা বিভক্ত হয়ে গেলাম। মত পার্থক্য যতই থাকুক কমরেড আসাদ্দর আলীর উন্নত চরিত্র ও গুনাবলির প্রশংসা না করে পারা যায় না। কমিউনিস্ট আদর্শে গঠিত তাঁর চারিত্রিক গুনাবলীর প্রশংসা না করে পারা যায় না। কমিউনিস্ট আদর্শে গঠিত তাঁর চারিত্রিক গুনাবলী আমাদের এই আধাসামন্তবাদী জরাজীর্ণ সমাজে এক ব্যতিক্রমী গুণাবলী। নির্বাচনে প্রার্থী হয়েও তিনি বুর্জোয়া রাজনীতির বেঈমানী আর প্রতারণার আশ্রয় নেননি। রাজনীতি করে স্বার্থ হাসিলের কোন মতলব তাঁর ছিল না। পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতি ও সাম্রাজ্যবাদের বিরেধীতার প্রশ্নে যখন আওয়ামীলীগের অভ্যন্তরে মতবিরোধ চলছিল তখন ক্ষমতাসীন সোহরাওয়ার্দী গ্র“পের সাথে থাকলে নানাভাবেই তিনি লাভবান হতে পারতেন, টাকা পয়সা অর্জনের সুযোগ করে নিতে পারতেন। কিন্তু নীতি ও আদর্শে অটল এক কমরেড তা করেননি। গণতন্ত্রমনা এই নেতা দলের প্রধানের হুকুমে চলতেন না। গণতান্ত্রিক পন্থায় গৃহীত সিদ্ধান্ত মতোই চলতেন। আজকের দিনের ছাত্র, যুবক, নেতাকর্মীরা সত্যিকার অর্থে গণতান্ত্রিক পন্থায় পরিচালিত হচ্ছেন না। এক উচ্ছৃংখল পথে তাদের ফেলে দেওয়া হয়েছে। আর এই উচ্ছৃংখলতার মূলে রয়েছে সাম্রাজ্যবাদীদের সাংস্কৃতিক আগ্রাসন এবং তাদের নয়া ঔপনিবেশিক পলিসি। এর ফলে যুব সম্প্রদায় বিনাশ হচ্ছে এবং আরও বিনাশ হবে। যারা চোখ থাকতে সাম্রাজ্যবাদকে দেখে না, মাথায় মগজ থাকতে নয়া উপনিবেশের শোষণ পক্রিয়া বুঝে না, যারা সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থের পাহারাদারী করে, সাম্রাজ্যবাদের সহায়তায় ক্ষমতায় যায় তারা এক রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা ও সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তনের রাজনীতি করে না। তারা মৌলিক পরিবর্তনের বিরোধী। কমরেড আসাদ্দর আলী এই মৌলিক পরিবর্তনের রাজনীতি করে গেছেন। তাঁর চলার পথকে অনুসরণ করা প্রগতিশীলদের উচিত।
ঢাকার হাসপাতালে তাঁকে গিয়ে দেখেছি। বুঝেছি তিনি আর বাঁচবেন না। তাঁর চেহারায় বিষন্নতা নেই, কোন রকম উদ্বেগও নেই। শয্যায় শায়িত অবস্থায় তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘আমার যে রোগ হয়েছে সে তো আমি বুঝতেই পারছি।’ তিনি নিজেই বুঝতে পেরে ছিলেন তিনি আর বাঁচবেন না। তাঁর এই সকাল কথাবার্তা শুনে আমার মনে পড়ে গেল এক কবির কবিতার কথা, ‘ওরে মন, শমন এলো তোর দ্বারে, বরণ করে নে তারে।’ মনে হচ্ছিল তিনি মৃত্যুর প্রতীক্ষায় রয়েছেন। মৃত্যু জীবনের পরিণতি। তবে কারো মৃত্যু জীবনের কর্মকান্ডের ও জীবনাদর্শের স্মৃতি রেখে যায়, রেখে যায় আদর্শগত অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করার তাগিদ। কমরেড আসাদ্দর আলী আমাদের দেশের শ্রমিক কৃষক সহ শোষিত জনতার মুক্তির সংগ্রামে শোষক শ্রেণীকে উচ্ছেদ করার সংগ্রামে একজন অগ্রসৈনিক। তাঁর সংগ্রাম অসমাপ্ত রেখেই তিনি চলে গেলেন। শোষক শ্রেণী ও সাম্রাজ্যবাদের দালালরা মনে করেছে আপদ গেছে। আর আমরা যারা প্রগতিশীল, সমাজের মৌলিক পরিবর্তনে আশাবাদী, আমাদের মনস্কামনা কী হওয়া উচিত? এই প্রসঙ্গে মহান লেনিনের একটা অমূল্য বাণী মনে পড়ে। জার্মান শ্রমিক আন্দোলনের প্রখ্যাত নেতা পালসিঙ্গারের মৃত্যুর পর লেনিন বলেছিলেন-The old revolutionary leaders are passing away, but the young army of the revolutionary proletariat is growing and gaining strength. কমরেড আসাদ্দর আলীর জীবনকে অনুসরণ করে আমাদের দেশেও বিপ্লবী সর্বহারার যুব বাহিনী জেগে উঠুক এবং জনগণের কাতারে একাত্ম হয়ে শক্তি সঞ্চয় করুক এই কামনা করে প্রয়াত কমরেড আসাদ্দর আলীর সারা জীবনের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি।
মফিজ আলী : একনিষ্ঠ দেশপ্রেমিক ও বিপ্লবী জননেতা।
Post a Comment
0 comments
কমরেড আসাদ্দর আলী বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় নাম।তিনি সারাজীবন মেহনতী মানুষের কল্যানে কাজ করে গেছেন।১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে তার অবিস্মরণীয় অবদান ছিল।তিনি কমিনিষ্ট আন্দোলনের পথিকৃত এবং বাংলাদেশের সাম্যবাদী দলের সাবেক সভাপতি ছিলেন।গণ মানুষের নেতা কমরেড আসাদ্দর আলীর স্বরনে একটি ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা মাত্র।সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ।